উপনিষদের সর্বেশ্বরবাদী ধর্ম : শিক্ষিত হিন্দুদের একাংশের কাছে ‘মহাভারতের চেয়ে গীতার কদর বেশি। একইভাবে ‘বেদের’ চেয়ে তাদের কাছে কদর বেশি ‘উপনিষদের’। সাধারণ হিন্দু অবশ্য বেদ, উপনিষদ ও গীতা এ তিনটি সম্বন্ধেই উদাসীন বা অজ্ঞ। তাদের জন্য সুখপাঠ্য হিসেবে রক্ষিত আছে রামায়ণ ও মহাভারত যা বর্ণাশ্রম (চার বর্ণ ও চার আশ্রম) ভিত্তিক ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রচার গ্রন্থ। ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রচারকরা উপনিষদকে কেন এত আদরের বস্তু মনে করে তা বোঝার জন্য ‘উপনিষদ’ প্রকাশকের বক্তব্যের আশ্রয় নেওয়া যাক।
উপনিষদের সর্বেশ্বরবাদী ধর্ম
কলকাতার প্রকাশনী সংস্থা ‘হরফ প্রকাশনী’ কর্তৃক বাংলায় প্রকাশিত ‘উপনিষদ (অখণ্ড সংস্করণ)’ এর প্রকাশক উপনিষদ সম্পর্কে বলছেন : ‘উপনিষদের বাণী চিরন্তন, এর আবেদন শাশ্বত। কালপ্রবাহে এর ক্ষয় নেই, লয় নেই। উপনিষদের বাণীতেই ভারতবর্ষের চিরন্তন আত্মাদি বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। ভারতীয় দর্শন, ধর্ম ও সংস্কৃতির আকর গ্রন্থ এই উপনিষদ।’ এ হেন উপনিষদ সম্পর্কে সাধারণ হিন্দু কেন, শিক্ষিত হিন্দুর সিংহ ভাগের কোনো ধারণা নেই বললেই চলে। এমতাবস্থায় উপরোক্ত উপনিষদকে ভিত্তি করে এর একটা সংক্ষিপ্ত পরিচয় নিচে তুলে ধরা হল। উল্লেখ্য এটি করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে ঐ গ্রন্থের ভাষা হুবহু ব্যবহার করা হয়েছে ।
১. উপনিষদ জগৎ ও স্রষ্টা বিষয়ক চিন্তার প্রাচীন সাক্ষর:
এ কথা ভাবতে কষ্ট হয় না যে মানুষ সৃষ্টির আদিকাল থেকে জন্ম, মৃত্যু, রোগ-শোক, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত থেকে শুরু করে বিশ্বজগতের নানাবিধ ঘটনা বিস্ময়ের সাথে অবলোকন করে আসছে। কিভাবে মানুষের জন্ম হচ্ছে, কেন মানুষ অসুস্থ হচ্ছে, কেন মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, মৃত্যুর পর মানুষ কোথায় যাচ্ছে, সূর্য কোত্থেকে উদিত হচ্ছে, অস্তমান সূর্য কোথায় যাচ্ছে এসব বিষয় তার মনে নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়। বলাবাহুল্য এসব প্রশ্ন জগৎ ও স্রষ্টা বিষয়ক াকে অধ্যাত্ব বিদ্যা বা ভগবদবিষয়ক বিদ্যা বলা হয়। ইতিহাসের প্রথম পর্যায়ে এ সম্বন্ধে মানুষ কী ভাবত তা আজ জানার উপায় নেই। কিন্তু নিকট অতীতে অর্থাৎ প্রাচীনকালে এ অঞ্চলের মানুষ এসব বিষয়ে কী ভাবত তার একটা ধারণা পাওয়া যায় বেদ ও উপনিষদ থেকে।
২. উপনিষদ শব্দের অর্থ:
বেদের বিভিন্ন জায়গায় জ্ঞানমূলক কিছু স্তোত্র/শোক/ঋক আছে। এগুলোকে একত্রে জ্ঞানকাণ্ড বা উপনিষদ বলা হয়। জ্ঞানকাণ্ডের বিষয়বস্তু ছাড়া বেদের আরও দুটো কাণ্ড আছে, যথা: সংহিতা ও ব্রাহ্মণ। সংহিতা ও ব্রাহ্মণে যাগ-যজ্ঞ প্রভৃতির বর্ণনা ও প্রণালী, উদ্দেশ্য, ফলশ্রুতি ও এদের দার্শনিক ব্যাখ্যা আছে। উপনিষদে এসব কিছু নেই। এতে আছে অধ্যাত্ম জ্ঞান যার ওপর হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতি দাঁড়িয়ে আছে বলে দাবি করা হয়।
‘উপনিষদ’ শব্দের অর্থ নিয়ে মতভেদ আছে। বেদের প্রান্তে বেদকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে বলে একে ‘উপনিষদ’ বলা হয়। কারও কারও মতে ‘উপনিষদ’ অর্থ অবশ্য রহস্যগত জ্ঞান। আবার কেউ কেউ বলেন গুরুর নিকট বসে দার্শনিক বিদ্যা আয়ত্ত্ব করা হতো বলে এর নাম ‘উপনিষদ’। লক্ষণীয় ‘উপনিষদ’ অর্থে ‘বেদান্ত’ শব্দও ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ উপনিষদ ও বেদান্ত সমার্থক।
উপনিষদকে পরাবিদ্যাও বলা হয়। বেদের অপর অংশকে অপরাবিদ্যা বলা হয়। পরাবিদ্যা হচ্ছে বিশ্বরহস্যকে উদ্ধার করার জ্ঞান বা জ্ঞান বা বিদ্যা।
৩. উপনিষদ রচনাকাল:
উপনিষদের ক্রমিক রচনাকাল ও প্রাচীনত্ব সম্বন্ধে নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না। ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার রাধাকৃষ্ণণের মত উদ্ধৃত করে বলছেন, উপনিষদের রচনাকাল ১০০০ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দ। অন্যান্যের মতে ৭০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ ।
৪. উপনিষদ অরণ্যে বসে রচিত:
সংসার জীবনের ঊর্ধ্বে উঠে একশ্রেণির উদাসীন লোক অরণ্যে বসে উপনিষদ রচনা করেন। উদ্দেশ্য জীবনের গূঢ় অর্থ আবিষ্কার করা। গভীর ধ্যানের মাধ্যমেই তাঁরা এই জ্ঞান লাভ করেন। শিষ্যরা ধ্যানীদের পদপ্রান্তে বসে এই জ্ঞান লাভ করতেন। অরণ্যে ধ্যানলব্ধ জ্ঞান বলে উপনিষদকে ‘আরণ্যক’ও বলা হয়। মজার বিষয় এই জ্ঞানের বিষয়গুলো সাধারণত বেদের ব্রাহ্মণ’ ভাগের পরিশিষ্টে স্থান পেতো।
৫. উপনিষদের রচয়িতা:
ইতিহাসবিদ ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদারের মতে বেদের কর্মকাণ্ড অর্থাৎ সংহিতা ও ব্রাহ্মণ অর্থাৎ যাগ-যজ্ঞানুষ্ঠান ইত্যাদি সম্পর্কিত শ্লোকগুলো রচনা করেছেন প্রধানত ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের লোকেরা। অপরদিকে বেদের জ্ঞানকাণ্ড বা উপনিষদ অর্থাৎ দার্শনিক চিন্তামূলক শ্লোকগুলো রচনা করেছেন প্রধানত ক্ষত্রিয় ও অন্যজাতির লোকেরা।
৬. উপনিষদের সংখ্যা:
উপনিষদের সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করা একটি কঠিন কাজ। কারণ দিনদিন এর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে বৈদিককালের পরেও অনেক উপনিষদ রচিত হয়েছে। এমনকি মোগল আমলেরও অনেক উপনিষদ পাওয়া যায় । এমতাবস্থায় বৈদিক যুগের উপনিষদগুলোকেই প্রকৃত ও প্রাচীন উপনিষদ বলে ধরে নেয়া হয়। এ ধরনের চৌদ্দটি উপনিষদের কথা শঙ্করাচার্য তাঁর ভাষ্যে উল্লেখ করেছেন। অবশ্য হিসেবে দেখা যায় বেদের অঙ্গ হিসেবে গণ্য ও গণ্য হতে পারে এমন উপনিষদের সংখ্যা সর্বমোট মাত্র ১২টি। এর মধ্যে বেদের অঙ্গীভূত উপনিষদ ৮টি।
ঐতিহ্য অনুসারে বেদের সহিত সংযুক্ত উপনিষদ আরও ৪টি। নিচে এর তালিকা দেওয়া হল:
উপরোক্ত ১২টি উপনিষদের মধ্যে ছয়টি প্রাচীনতম বলে বিবেচিত। এগুলো হচ্ছে:
ঐতরেয়, বৃহদারণ্যক, ছান্দোগ্য, তৈত্তিরীয়, কৌষীতকি এবং কেন। উল্লেখ্য, বেদান্ত দর্শনের আদিরূপ এই উপনিষদগুলোতেই পাওয়া যায়। অপরদিকে বাকি ছয়টি উপনিষদ, যথা: কঠ, শ্বেতাশ্বতর, ঈশ, মুণ্ডক, মাণ্ডক্য ও প্রশ্ন ইত্যাদিতে বেদান্তদর্শন বাদে সাংখ্য ও যোগ দর্শনের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
৭. উপনিষদের প্রকারভেদ:
উপনিষদগুলোকে মোটামুটিভাবে তিন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়, যথা:
ক. প্রাচীন বা ব্রহ্মবাদী উপনিষদ,
খ. যোগ বা সন্ন্যাসবাদী উপনিষদ ও
গ. ভক্তিবাদী বা পৌরাণিক দেবতাবাদী উপনিষদ।
৮. উপনিষদের দর্শন:
হিরন্ময় বন্দোপাধ্যায়ের মতে ভারতীয় দর্শনে চারটি চিন্তরি স্তর আছে। প্রথমটি বেদের সংহিতা অংশের বহু দেবতাবাদ, দ্বিতীয় স্তরটি হচ্ছে বেদের উপনিষদ অংশের ‘সর্বেশ্বরবাদ, তৃতীয় স্তরটি হচ্ছে ষড় দর্শন যুগের জ্ঞানমার্গের মুক্তিবাদ এবং সর্বশেষ স্তরটি হচ্ছে পুরাণের যুগে ব্যক্তিরূপী ঈশ্বরকে ভিত্তি করে তৈরি ‘ভক্তিবাদ’। তা হলে দেখা যাচ্ছে উপনিষদের দর্শনটি ভারতীয় দর্শনের দ্বিতীয় স্তরের দর্শন অর্থাৎ ‘সর্বেশ্বরবাদ’। উপনিষদের ‘সর্বেশ্বরবাদ’ আলোচনার সুবিধার্থে উপরোক্ত চারটি দার্শনিক স্তরই বোঝা দরকার। নিচে এই স্তরগুলোর একটি পরিচয় তুলে ধরা হল:
ক. বেদের ‘বহু দেবতাবাদ’ :
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ৪টি বেদ দীর্ঘ সময় ধরে রচিত হয়েছে। বেদের প্রথম দিককার রচনায় অর্থাৎ সংহিতা অংশে ঋষিরা সৃষ্টি, দেবতা, জগৎ ইত্যাদি সম্বন্ধে যা ভেবেছেন তা থেকে বোঝা যায় তারা যেখানেই কোনো শক্তি বা সৌন্দর্য দেখেছেন তার ওপরই দেবত্ব আরোপ করেছেন। এভাবে অগ্নি, বরুণ, মরুৎ, ঊষা প্রভৃতি দেবতার উদ্ভব হয়েছে এবং তাদের উদ্দেশে ঋষিরা যজ্ঞ করেছেন। যজ্ঞের পাশাপাশি এই ধারণাও জন্ম নেয় যে বিশ্বকে বহু দেবতা নিয়ন্ত্রণ করছেন। বহুদেবতা নিয়ন্ত্রিত বিশ্বের পরিকল্পনা থেকে এই ধারণা গড়ে উঠে যে বিশ্ব একটি মাত্র নৈর্ব্যক্তিক মহাশক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই শক্তিকে পুরুষ, আত্মা বা সৎ ইত্যাদি নামে ডাকা হয়েছে।
খ. উপনিষদের সর্বেশ্বরবাদ
পরবর্তীকালে রচিত বেদের অংশে অর্থাৎ উপনিষদে বর্ণিত বিশ্বতত্ত্ব বলছে বিশ্ব হল সৃষ্টি এবং ব্রহ্ম হল স্রষ্টা। সৃষ্টি ও স্রষ্টা ওতপ্রোতভাবে জড়িত অর্থাৎ বিশ্বের মধ্যে বিশ্বশক্তি প্রচ্ছন্নভাবে ক্রিয়াশীল। সেই শক্তিই বিশ্বের আশ্রয় এবং সেই শক্তিই সমগ্রভাবে বিশ্বকে একত্বমণ্ডিত করেছে। বিশ্বশক্তি বিশ্বের মধ্যেই ছড়িয়ে রয়েছে। এই তত্ত্বই উপনিষদের ব্রহ্মবাদের মূল সুর। ব্রহ্ম সবকিছু ব্যাপ্ত করে আছেন, ব্রহ্ম সবকিছু ধারণ করে আছেন এবং সবকিছুর অন্তরে অধিষ্ঠান করছেন।
উপনিষদ মতে বিশ্ব একটি অঙ্গবিশিষ্ট অঙ্গীরূপে পরিকল্পিত; তা বিশুদ্ধভাবে এক নয়, সকলকে জড়িয়ে এক। তাতে বহু ও পৃথক পদার্থের সমাবেশ আছে, কিন্তু তারা একই ব্যাপক সত্তার মধ্যে বিধৃত। সেই সত্তা বিশ্বের বিভিন্ন অংশের মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে ক্রিয়াশীল থেকে বিশ্বকে নিয়ন্ত্রিত করে (তাই অন্তর্যামী) এবং দ্বৈতভাবে চিহ্নিত হয়ে বিচিত্ররূপে প্রকট হয়। এর অর্থ ঈশ্বর বিশ্ব হতে পৃথক নন। তিনি নৈর্ব্যক্তিক শক্তি। এটিই উপনিষদের ‘সর্বেশ্বরবাদ’।
পরবর্তীকালে ভারতীয় অধ্যাত্মদর্শন:
ঋষিদের ঈশ্বর সম্বন্ধীয় জ্ঞান অন্বেষণ ‘বহুদেবতাবাদ’ থেকে ‘সর্বেশ্বরবাদে’ এসেই থেমে থাকেনি। পরবর্তীকালে ভারতীয় অধ্যাত্মদর্শনে আরও দুটো পরিবর্তন ঘটে। এ দুটো অধ্যাত্মদর্শন নিম্নরূপ:
ক. ষড়দর্শনের যুগ:
উপনিষদের ঋষিদের স্রষ্টা সম্বন্ধীয় জিজ্ঞাসা ছিল নিতান্তই কৌতূহলজাত ষড়দর্শনের যুগে ব্যবহারিক জীবনের প্রয়োজনের সাথে দর্শনকে সমন্বিত করা হয়। এ যুগে কর্মফল ভোগ ও তার জন্য জন্মান্তর গ্রহণের ধারণা বদ্ধমূল হয়। এর থেকে অর্থাৎ জন্মান্তর গ্রহণের বৃত্ত থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে জ্ঞানমার্গকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। ষড়দর্শনে জ্ঞানমার্গের যেমন আধিপত্য, তেমনি বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মেও জ্ঞানমার্গের আধিপত্য। এ পর্যায়ের দর্শনে দেখা যায় সকলেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে নীরব।
খ. ব্যক্তি-ঈশ্বর কেন্দ্রিক একেশ্বরবাদ :
সর্বশেষ পর্যায়ে দেখা যায় ঈশ্বরকে বিশ্বতত্ত্বের কেন্দ্রস্থলে স্থাপন করে তাঁর ওপর সকল মৌলিক শক্তি আরোপ করা হয় এবং তাঁকে ব্যক্তিসত্তারূপে কল্পনা করা হয়। ব্যক্তি ঈশ্বরকে ভক্তি করেই মুক্তিলাভ সম্ভব এটিই প্রচার করা হয়। বলা বাহুল্য এভাবেই রাম ও কৃষ্ণ দেবতার নষ্টি।
ইদানীংকালে আবার দেখা যায় রাম ও কৃষ্ণের স্থলে ‘লোকনাথ’ (ঘোষাল পদবিধারী এক ব্যক্তি) ও রামকৃষ্ণ (চট্টোপাধ্যায় পদবিধারী এক ব্যক্তি) নামীয় ব্যক্তিদের বসানোর চেষ্টা চলছে।
৯. উপনিষদের বাণীগুলো সুসংবদ্ধ নয়:
উপনিষদের বাণী নানা মুনি-ঋষি কর্তৃক বহুকাল ধরে বিভিন্ন সময়ে রচিত। এতে অন্যান্য দর্শনের মতো তথ্য ও যুক্তির অবতারণা খুবই কম। ঋষিগণ বিশ্বের সমস্যাকে যেভাবে দেখেছেন, এ সম্বন্ধে তারা যেভাবে চিন্তা করেছেন তাই কবিসুলভ ভাষায় লিপিবদ্ধ করে গেছেন। ফলে উপনিষদে সাজানো গুছানো কোনো বাণী নেই। বাণীগুলো নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তবে এতে ভাবধারার ঐক্য আছে বলে দাবি করা হয়। কিন্তু ভাবধারার এই কথিত ঐক্যকে সাজিয়ে দর্শন গড়ে তোলা এক কঠিন কাজ। এমতাবস্থায় উপনিষদ বোঝার জন্য নানা মতাবলম্বী টীকাকারের টীকার ওপর নির্ভর করতে হয়। এতে সাধারণ পাঠক, এমনকি শিক্ষিত পাঠকও উপনিষদের মূল ভাব কী তা নিয়ে বিভ্রান্তির সম্মুখীন হন।
১০. শংকরাচার্যের মায়াবাদ উপনিষদে অনুপস্থিত :
শংকরাচার্য পৃথক ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। তাঁর কাছে ঈশ্বর বিশ্বের সঙ্গে একীভূত। শংকরাচার্য বলেন, বিশ্বসত্তা অবিভাজ্য। এই মতকে ‘অদ্বৈতবাদ’ বলা হয়। এটি ‘মায়াবাদ’ বলেও পরিচিত। অর্থাৎ বিশ্ব ব্রহ্ম হতে পৃথক নয়, তাকে ভুল করে আমরা বহু আকারে দেখি। বিপরীতে উপনিষদ উক্ত মতবাদ বলে, বিশ্বের স্রষ্টা ও সৃষ্টি পৃথক। স্রষ্টার সাথে ভক্তিসূত্রে সৃষ্টির সম্বন্ধ স্থাপিত হয়। এরা মূলত একেশ্বরবাদী কিন্তু ঈশ্বরকে ব্যক্তিবিশিষ্ট রূপে বর্ণনা করে। এদেরকে বৈষ্ণবপন্থী বেদান্ত বলা হয়। এমতাবস্থায় বলা যায় ‘অদ্বৈতবাদ’ বা ‘মায়াবাদ’ উপনিষদের মূল ভাবধারার দ্বারা সমর্থিত নয়। প্রকৃতপক্ষে উপনিষদের কালে ব্যক্তিরূপী ঈশ্বরের কোনো ধারণাই গড়ে ওঠেনি
১১. উপনিষদ জীবনবিমুখ নয়:
ড. রমেশ মজুমদারের মতে উপনিষদের শিক্ষা মানুষকে জীবন বিমুখ করে না। বরং বলে পরিপূর্ণ জীবনের কথা যে জীবন জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তি বা প্রেম দ্বারা ব্রহ্মের সাথে সর্বদাই যুক্ত।
১২. উপনিষদ সন্ন্যাসী হতে বলে না:
হিরন্ময় বন্দোপাধ্যায়ের মতে উপনিষদ কৃচ্ছ্রসাধন বা সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হতে উপদেশ দেয় নি। বরং তাতে বলা হয়েছে ত্যাগ ও ভোগের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করতে। ইন্দ্রিয় যা চায় তাকে বিসর্জন দিতে বলা হয় নি। বলা হয়েছে ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রিত রাখতে যাতে শ্রেয় পথে চলা যায় শ্রেয় পথ হচ্ছে সামগ্রিক কল্যাণের পথ যা সমাজের মঙ্গল করে। এটি প্রেয় পথের বিপরীত। প্রেয় পথে নিজের স্বার্থই বড়। তাই ইন্দ্রিয় (বিষয় ইচ্ছা) দমনের প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন ইন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণের। উদাহরণস্বরূপ কঠ উপনিষদের কথা বলা যায়। এতে বলা হয়েছে ইন্দ্রিয় হচ্ছে অশ্বের মত বিষয়ের প্রতি প্রবল আকর্ষণ। শ্রেয়র পথে চলতে হলে ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রিত রাখতে হবে।
১৩. উপনিষদ একা ভোগ করতে বলে না:
ঈশ উপনিষদে বলা হয়েছে স্বার্থপরের মত একলা ভোগ করতে নেই, ত্যাগের সাথে ভোগ করতে হয়, ভাগ করে ভোগ করতে হয়। কারণ বিশ্বের সকলেই আপনজন।
মহাভারত : রাজ্যের জন্য জ্ঞাতিযুদ্ধ : জনপ্রিয় দুটো ভারতীয় মহাকাব্যের মধ্যে মহাতারকা জেকট্রিটি অনেকের এটি কাছে এটি ইতিহাস। আবার অনেকের কাছে তা ভারতের প্রাচীনতম মহাকাব্য। আবার অনেক লোকের কাছে মহাভারত একটি ধর্মগ্রন্থ। যে যেভাবেই গ্রহণ করুক না কেন কথা সত্যি যে মহাভারত প্রাচীন কাহিনী, ঐতিহ্য ও সংস্কৃি অমূল্য ভাণ্ডার। বলা হয় যা নেই মহাভারতে, তা নেই ভূ-ভারতে। কমপক্ষে দু-তিন হাজার বছর যাবত মহাভারতের নানা উপাখ্যান কোটি কোটি মানুষের মনোরঞ্জন করে আসছে।
মহাভারত : শ্রীকৃষ্ণ যখন অর্জুনের সারথি
মহাভারত : রাজ্যের জন্য জ্ঞাতিযুদ্ধ – ড: আর এম দেবনাথ
মহাভারত এ অঞ্চলের মানুষকে যেমন ধর্মতত্ত্ব শিখিয়েছে, তেমনি সাহিত্যিক-দেরকে যুগিয়েছে সাহিত্য সৃষ্টির অফুরন্ত উপাদান। মহাভারতের নানা কাহিনী আজও কাজ করছে লোকশিক্ষার অন্যতম প্রধান উপাদান হিসেবে। এ গ্রন্থের বীরদের উদাহরণ অনেক লোকের কাছে একটি আদর্শ। মহাভারতের নায়কদের অনেক বক্তব্য আজও প্রবাদ হিসেবে কাজ করে।
যদিও সকলের কাছেই আকর্ষণীয় একটি গ্রন্থ তথাপি বিরাট কলেবরের মহাভারত সকল পাঠকের পক্ষে ধৈর্য্য ধরে পড়া সম্ভব নয়। অথচ সকলেই জানতে চান এতে কী আছে। এ কথা মনে রেখে নিচে মহাভারতের সংক্ষিপ্ত একটি পরিচয় তুলে ধরা হল। উল্লেখ্য এটি করতে গিয়ে রাজশেখর বসু কর্তৃক বাংলায় অনুদিত মহাভারতের ওপর বহুলাংশে নির্ভর করা হয়েছে। এছাড়াও অন্যান্য গ্রন্থকারের মহাভারতের সাহায্যও নেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের ব্যবহৃত ভাষাই ব্যবহার করা হয়েছে।
১. মহাভারতের রচয়িতা রচনাকাল:
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস এই গ্রন্থের রচয়িতা বলে মহাভারতে উল্লেখিত হয়েছে। ব্যাসদেব প্রকৃতপক্ষে ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডুর পিতা। অর্থাৎ মহাভারতের যুদ্ধ ব্যাসদেবের নাতিদের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ। ব্যাসদেব তাঁর পৌত্রের প্রপৌত্র জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞে নিজের শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত পাঠের আদেশ দেন। গোড়া পণ্ডিতগণের মতে কুরুক্ষেত্রযুদ্ধের কাল খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দের কাছাকাছি এবং তার কিছুকাল পরে মহাভারত রচিত হয়।
ইওরোপীয় পণ্ডিতগণের মতে আদিগ্রন্থের রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যে। খ্রিস্টজন্মের পরেও অনেক অংশ যোজিত হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্রের মতে কুরুক্ষেত্রযুদ্ধের কাল খ্রিস্টপূর্ব ১৫৩০ ১৪৩০। তিলক অধিকাংশ আধুনিক পণ্ডিতগণের মতে প্রায় ১৪০০ ‘কৃষ্ণচরিত্র’ গ্রন্থে বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন, ‘যুদ্ধের অনল্প পরেই আদিম মহাভারত প্রণীত হইয়াছিল বলিয়া যে প্রসিদ্ধি আছে তাহার উচ্ছেদ করিবার কোনও কারণ দেখা যায় না। ‘বর্তমান মহাভারতের সমস্তটা এককালে রচিত না হলেও এবং তাতে বহু লোকের হাত থাকলেও সমগ্র রচনাই এখন কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের নামে চলে।
২. মহাভারতের বিষয়বস্তু:
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকে কেন্দ্র করে মহাভারতের কাহিনী আবর্তিত। কাহিনীর কেন্দ্রে যুদ্ধকে রেখে মহাভারতে ভরত বংশের ইতিহাস, যুদ্ধের বর্ণনা, নানা প্রাচীন উপাখ্যান, ধর্মকথা ও গীতা ইত্যাদির বিপুল সমাবেশ ঘটানো হয়েছে।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধটি সংঘটিত হয় কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে। পক্ষ দুটোর নাম কৌরব ও পাণ্ডব পক্ষ হলেও প্রকৃতপক্ষে উভয়পক্ষই কুরু বংশের লোক অর্থাৎ কৌরব। অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু দুই ভাই। দু’জনই প্রকৃতপক্ষে ব্যাসদেবের সন্তান যদিও তারা বিচিত্রবীর্যের সন্তান বলে পরিচিত। যুদ্ধ সংঘটিত হয় ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর সন্তানগণের মধ্যে। মজার ঘটনা দৃশ্যত যদিও জানা যাচ্ছে ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর সন্তানদের মধ্যে যুদ্ধ, প্রকৃতপক্ষে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ কেউ তার ঔরসজাত নন, তেমনি নন পাণ্ডবগণও পাণ্ডুর ঔরসজাত।
মহাভারতের বর্ণনায় দেখা যাচ্ছে পিতা বিচিত্রবীর্যের মৃত্যুর পর সাধারণ ঐতিহ্যে রাজা হওয়ার কথা জ্যেষ্ঠ পুত্র ধৃতরাষ্ট্র। কিন্তু তিনি অন্ধ হওয়ায় তাঁকে রাজা না করে রাজা করা হয় কনিষ্ঠ পুত্র পাণ্ডুকে। পাণ্ডুর মৃত্যুতে ধৃতরাষ্ট্র রাজ্যলাভ করেন। ইতিমধ্যে পাণ্ডুর পাঁচ সন্তান (পঞ্চ পাণ্ডব) শত্রুতা ও ঈর্ষার কারণে রাজ্য ত্যাগ করতে বাধ্য হন। ফিরে এসে তাঁরা রাজ্যের কিছু অংশ ফেরত পান এবং সুখেই দিন কাটান। কিন্তু যুধিষ্ঠির দুর্যোধনের সাথে পাশা খেলায় হেরে যাওয়ায় পুনরায় তারা ১২ বছরের জন্য বনবাসে যেতে বাধ্য হন। তারা আবার রাজ্যে ফিরে আসলে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন। সেই থেকেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সূত্রপাত ।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ চলে মাত্র ১৮ দিন। যুদ্ধ শেষে জীবিত ছিলেন মাত্র দশজন। এর মধ্যে পাণ্ডবপক্ষে সাতজন যথা: যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব, শ্রীকৃষ্ণ ও মাত্যকি। কৌরবপক্ষের জীবিতরা ছিলেন কৃপাচার্য, কৃতবর্মা ও অশ্বত্থামা।
৩. মহাভারতের কয়েকটি প্রসিদ্ধ চরিত্র:
মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র হচ্ছে : মূল আখ্যানের ব্যাস, শান্তনু, ভীষ্ম, ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী, কুন্তী, বিদুর, দ্রোণ, অশ্বত্থামা, পঞ্চপাণ্ডব, দ্রৌপদী, দুর্যোধন, কর্ণ, শকুনি, কৃষ্ণ, সত্যভামা, বলরাম, শিশুপাল, শল্য, অম্বা-শিখণ্ডী এবং উপাখ্যান বর্ণিত দেবযানী, শর্মিষ্ঠা, বিপুলা, নল, দময়ন্তী, ঋষ্যশৃঙ্গ, সাবিত্রী প্রভৃতি। নিচে এদের কয়েকজনের পরিচয় রাজশেখর বসুর গ্রন্থ থেকে তুলে দেওয়া হল :
মহাভারতের গুরুত্বপূর্ণ সকল চরিত্র
ক. কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস:
ব্যাসদেব বিচিত্রবীর্যের বৈপিত্র ভ্রাতা এবং ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর পিতা। তিনি কৃষ্ণবর্ণ ছিলেন। তাঁর রূপ, বেশ ও গন্ধ কুৎসিত ছিল। তিনি শান্তনু থেকে আরম্ভ করে জনমেজয় পর্যন্ত সাতপুরুষ ধরে জীবিত ছিলেন। ইনি মহাজ্ঞানী সিদ্ধপুরুষ, কিন্তু সুপুরুষ মোটেই নন। শাশুড়ী সত্যবতীর অনুরোধে অম্বিকা ও অম্বালিকা অত্যন্ত বিতৃষ্ণায় ব্যাসের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন। অম্বিকা চোখ বুজে ভীষ্মাদিকে ভেবেছিলেন বলে ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ হিসেবে জন্ম গ্রহণ করেন। অম্বালিকা ভয়ে পাণ্ডুবর্ণ হয়ে গিয়েছিলেন বলে পাণ্ডু পাণ্ডুর বর্ণ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন। ব্যাস তৃতীয়বার মিলিত হতে চাইলে অম্বিকা ও অম্বালিকা চাকরানি পাঠিয়ে দেন। এই মিলনের ফল হচ্ছে বিদুর। এভাবেই ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ডু বিদুরের জন্মদাতা ব্যাসদেব।
খ. ভীষ্ম :
শান্তনু রাজার পুত্র। তিনি দ্যূতসভায় দ্রৌপদীকে রক্ষা করেন নি। ভীষ্ম যুদ্ধে দুর্যোধনের পক্ষে যোগ দেন এবং পরিশেষে পাণ্ডবদের হিতার্থে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি তাঁর কামুক পিতার জন্য কুরুরাজ্যের উত্তরাধিকার ত্যাগ করেন। চিরকুমারব্রত নিয়ে দুই অপদার্থ বৈমাত্রেয় ভ্রাতা চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্যের অভিভাবক হন, এবং আজীবন নিষ্কামভাবে ভ্রাতার বংশধরদের সেবা করেন। তাঁর পিতৃ-ভক্তি অনুকরণীয়, কিন্তু অনুপযুক্ত কারণে তিনি অসাধারণ ত্যাগ স্বীকার করেন। ভীষ্ম তাঁর ভ্রাতার জন্য কাশীরাজের তিন কন্যাকে স্বয়ংবরসভা থেকে হরণ করেছিলেন, কিন্তু জ্যেষ্ঠা অম্বা শাল্বরাজের অনুরাগিণী জেনে তাঁকে সসম্মানে শাল্বের কাছে পাঠিয়ে দেন। অভাগিনী অম্বা সেখানে প্রত্যাখ্যাত হয়ে সংকল্প করেন যে তিনি ভীষ্মের বধসাধন করবেন।
গ. ধৃতরাষ্ট্র :
ধৃতরাষ্ট্র অব্যবস্থিতচিত্ত, তাঁর নীচতা আছে, উদারতাও আছে। দুর্যোধন তাঁকে সম্মোহিত করে রেখেছিলেন। অস্থিরমতি হতভাগ্য অন্ধ বৃদ্ধের ধর্মবুদ্ধি মাঝে মাঝে জেগে ওঠে, তখন তিনি দুর্যোধনকে ধমক দেন। সংকটে পড়লে তিনি বিদুরের কাছে মন্ত্রণা চান, কিন্তু স্বার্থত্যাগ করতে হবে শুনলেই চটে ওঠেন। ধৃতরাষ্ট্রের আন্তরিক ইচ্ছা যুদ্ধ না হয় এবং দুর্যোধন যা অন্যায় উপায়ে দখল করেছেন তা বজায় থাকে। কৃষ্ণ যখন পাণ্ডবদূত হয়ে হস্তিনাপুরে আসেন তখন ধৃতরাষ্ট্র তাঁকে ঘুষ দিয়ে বশে আনবার ইচ্ছা করেন দারুণ শোক পেয়ে জীবনের শেষদিকে তাঁর স্বভাব পরিবর্তিত হয়, যুধিষ্ঠিরকে তিনি পুত্রতুল্য জ্ঞান করতেন।
ঘ. গান্ধারী :
গান্ধারী মনস্বিনী, তিনি পুত্রের দুর্বৃত্ততা ও স্বামীর দুর্বলতা দেখে শঙ্কিত হন, ভর্ৎসনাও করেন, কিন্তু প্রতিকার করতে পারেন না। শতপুত্রের মৃত্যুর পর কৃষ্ণ ও যুধিষ্ঠিরের উপর তাঁর অতি স্বাভাবিক বিদ্বেষ হয়েছিল, কিন্তু তা দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। পরিশেষে তিনিও পাণ্ডবগণকে পুত্রতুল্য জ্ঞান করতেন।
ঙ. কুন্তী :
কুন্তী দৃঢ়চরিত্রা তেজস্বিনী বীরনারী, দ্রৌপদীর যোগ্য শাশুড়ী। যখনই মনে করেছেন যে পুত্রেরা নিরুদ্যম হয়ে আছে তখনই তিনি তীক্ষ্ণ বাক্যে তাঁদের উৎসাহিত করেছেন। উদ্যোগপর্বে কুন্তী যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন, ‘পুত্র, তুমি মন্দমতি, শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণের ন্যায় কেবল শাস্ত্র আলোচনা করে তোমার বুদ্ধি বিকৃত হয়েছে, তুমি কেবল ধর্মেরই চিন্তা
চ. যুধিষ্ঠির :
যুধিষ্ঠির অর্জুনের তুল্য কীর্তিমান নন, কিন্তু তিনিই মহাভারতের নায়ক ও কেন্দ্রস্থ পুরুষ। তিনি নির্বোধ নন, কিন্তু দ্যূতপ্রিয়তা (জুয়া), উদারতা ও ধর্মভীরুতার জন্য সময়ে সময়ে তিনি কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তিনি যুদ্ধপটু নন। দ্রোণবধের উদ্দেশ্যে কৃষ্ণের প্ররোচনায় তিনি মিথ্যা বলেছেন। তবে সাধারণত পাপপুণ্যের সূক্ষ্ম বিচার করে তিনি কর্ম করেন। এজন্য দ্রৌপদী আর ভীমের কাছে তাঁকে বহু ভর্ৎসনা শুনতে হয়েছে।। বার বার তাঁর মুখে বৈরাগ্যের কথা শুনে ব্যাসদেবও বিরক্ত হয়ে তাঁকে ভর্ৎসনা করেছেন।
যুধিষ্ঠির দৃঢ়চিত্ত, যা সংকল্প করেন তা করেন। কপট উপায়ে দ্রোণবধের জন্য অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে তিরস্কার করেছিলেন, কিন্তু যুধিষ্ঠির তাতে অনুতপ্ত হন নি। অশ্বত্থামা যখন নারায়ণাস্ত্রে পাণ্ডবসৈন্য বধ করছিলেন তখন অর্জুনকে নিশ্চেষ্ট দেখে যুধিষ্ঠির দ্রোণের অন্যায় কার্যাবলীর উল্লেখ করে ব্যাঙ্গ করে বললেন, ‘আমাদের সেই পরম সুহৃৎ নিহত হয়েছেন, অতএব আমরাও সবান্ধবে প্রাণত্যাগ করব।’ ভীম নাভির নিম্নে গদাপ্রহার করে দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ করলেন দেখে বলরাম অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ভৎর্সনা করে চলে গেলেন। তখন যুধিষ্ঠির বিষণ্ণ হয়ে কৃষ্ণকে বললেন, ‘ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা আমাদের উপর বহু অত্যাচার করেছে, সেই দারুণ দুঃখ ভীমের হৃদয়ে হয়েছে, এই চিন্তা করে আমি ভীমের আচরণ উপেক্ষা করলাম।
যুধিষ্ঠিরের মহত্ত্ব সবচেয়ে প্রকাশ পেয়েছে শেষ পর্বে। তিনি স্বর্গে এলে ইন্দ্র তাঁকে ছলক্রমে নরকদর্শন করতে পাঠালেন। যুধিষ্ঠির মনে করলেন তাঁর ভ্রাতারা ও দ্রৌপদী সেখানেই যন্ত্রণাভোগ করছেন। তখন তিনি স্বর্গের প্রলোভন ও দেবতাদের অনুরোধ উপেক্ষা করে বললেন, ‘আমি ফিরে যাব না, এখানেই থাকব।’
মহাভারতে পাণ্ডব ভ্রাতাগণ
ছ. ভীম:
ভীমকে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন, ‘রক্তপ রাক্ষস। যুধিষ্ঠিরের মুখে অশ্বত্থামার মিথ্যা মৃত্যুসংবাদ শুনে দ্রোণ যখন অবসন্ন হয়েছেন তখন ভীম নির্মম ভাষায় দ্রোণকে তিরস্কার করেন। ভীম কর্তৃক দুঃশাসনের রক্তপানের বিবরণ ভীষণ ও বীভৎস। ভীম তাঁর বৈমাত্র ভ্রাতা হনুমানের মত আরাধ্য হতে না পারলেও জনপ্রিয় হয়েছেন। চমৎকার কুযুক্তি দিতে পারতেন।
বনবাসে তের মাস যেতে না যেতে তিনি অধীর হয়ে পড়েন। ভীম মাংসলোভী পেটুক ছিলেন এবং তাঁর গোঁফদাঁড়ির অভাব ছিল। কর্ণ তাঁকে ঔদরিক আর তুবরক (মাকুন্দ) বলে খেপাতেন। ধৃতরাষ্ট্রাদির অপরাধ ভীম কখনই ভুলতে পারেন নি। যুধিষ্ঠিরের আশ্রিত পুত্রহীন জ্যেষ্ঠতাতকে কিঞ্চিৎ অর্থ দিতেও তিনি আপত্তি করেন। তাঁর গঞ্জনা সইতে না পেরেই ধৃতরাষ্ট্র বনে যেতে বাধ্য হন।
জ. অর্জুন :
অর্জুন মহাভারতের বীরগণের মধ্যে অগ্রগণ্য। তিনি কৃষ্ণের সখা ও মন্ত্রশিষ্য, প্রদ্যুম্ন ও সাত্যকির অস্ত্রশিক্ষক, নানা বিদ্যায় বিশারদ এবং অতিশয় রূপবান। মহাকাব্যের নায়কোচিত সমস্ত লক্ষণ তাঁর আছে, এই কারণে এবং অত্যধিক প্রশস্তির ফলে তিনি কিঞ্চিৎ অস্বাভাবিক হয়ে পড়েছেন। অর্জুন ধীর প্রকৃতি, কিন্তু মাঝে মাঝে অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। কর্ণপর্বে যুধিষ্ঠির তাঁকে তিরস্কার করে বলেছিলেন, তোমার গাণ্ডীব ধনু অন্যকে দাও। তাতে অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে কাটতে গেলেন, অবশেষে কৃষ্ণ তাঁকে শাস্ত করলেন । কুরুক্ষেত্রযুদ্ধের পূর্বক্ষণে কৃষ্ণ অর্জুনকে গীতার উপদেশ শুনিয়েছিলেন।
ঝ. দ্রৌপদী:
দ্রৌপদী সীতা-সাবিত্রীর সম্মান পান নি। কিন্তু তিনি সর্ব বিষয়ে অসামান্যা। প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে অন্য কোনও নারী তাঁর তুল্য জীবন্ত রূপে চিত্রিত হন নি। তিনি অতি রূপবতী, কিন্তু শ্যামাঙ্গী সেজন্য তাঁর নাম কৃষ্ণা। একবার সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ তাঁকে হরণ করতে আসেন। তখন বয়সের হিসাবে দ্রৌপদী যৌবনের শেষ প্রান্তে, তথাপি জয়দ্রথ তাঁকে দেখে বলছেন, ‘এ’কে পেলে আর বিবাহের প্রয়োজন নেই, এই নারীকে দেখে মনে হচ্ছে অন্য নারীরা বানরী।
মহাভারত টেলিভিশন সিরিয়াল
দ্রৌপদী অসহিষ্ণু তেজস্বিনী, স্পষ্টবাদিনী, তীক্ষ্ণ বাক্যে নিষ্ক্রিয় পুরুষদের উত্তেজিত করতে পারেন। তাঁর বাগ্মিতার পরিচয় অনেক স্থানে পাওয়া যায়। বহু কষ্ট ভোগের কারণে মঙ্গলময় বিধাতায় তাঁর আস্থা ছিল না। তবু দ্রৌপদী মাঝে মাঝে তাঁর পঞ্চ স্বামীকে বাক্যবাণে পীড়িত করেন, স্বামীরা তা নির্বিবাদে সয়ে যান। তাঁরা দ্রৌপদীকে সম্মান ও সমাদর করেন। দ্রৌপদী পাঁচ স্বামীকেই ভালবাসেন। যুধিষ্ঠির তাঁকে অনেক জ্বালিয়েছেন, তথাপি দ্রৌপদী তাঁর জ্যেষ্ঠ স্বামীকে ভক্তি করেন, অনুকম্পা ও কিঞ্চিৎ অবজ্ঞাও করেন। বিপদের সময় দ্রৌপদী ভীমের উপরেই বেশি ভরসা রাখেন।
দ্রৌপদী নকুল সহদেবকে তিনি দেবরের ন্যায় স্নেহ করেন। অর্জুন তাঁর প্রথম অনুরাগের পাত্র, পরেও বোধ হয় অর্জুনের উপরেই তাঁর প্রকৃত প্রেম ছিল। দ্রৌপদীর একটি বৈশিষ্ট্য – কৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর স্নিগ্ধ সম্বন্ধ। তিনি কৃষ্ণের সখী এবং সুভদ্রার ন্যায় স্নেহভাগিনী, সকল সংকটে কৃষ্ণ তাঁর শরণ্য ও স্মরণীয়।
ঞ. দুর্যোধন:
দুর্যোধন মহাভারতের প্রতিনায়ক। তিনি রাজ্যলোভী বা প্রভুত্বলোভী ও ধর্মজ্ঞানহীন। তিনি আমৃত্যু পাণ্ডবদের অনিষ্ট করেছেন, নিজেও ঈর্ষা ও বিদ্বেষে দগ্ধ হয়েছেন। তাঁর দুই মন্ত্রণাদাতা কর্ণ ও শকুনি। দুর্যোধন নিয়তিবাদী। রাজা দুর্যোধন প্রজাদের প্রতি কোনও দুর্ব্যবহার করেন নি। যুধিষ্ঠির স্বর্গে গিয়ে দুর্যোধনকে দেখে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। নারদ তাঁকে প্রবোধ দিয়ে বললেন, ইনি ক্ষত্রধর্মানুসারে যুদ্ধে নিজ দেহ উৎসর্গ করে বীরলোক লাভ করেছেন, মহাভয় উপস্থিত হলেও ইনি কখনও ভীত হন নি।’
ট. কর্ণ:
বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন, ‘কর্ণচরিত্র অতি মহৎ ও মনোহর। কর্ণচরিত্রে নীচতা ও মহত্ত্ব দুইই দেখা যায়। বহু রচয়িতার হাতে পড়ে কর্ণচরিত্রের এই বিপর্যয় ঘটেছে।। কর্ণপর্ব ১৮-পরিচ্ছেদে অর্জুনকে কৃষ্ণ বলেছেন, ‘জতুগৃহদাহ, দ্যূতক্রীড়া এবং দুর্যোধন তোমাদের উপর যত উৎপীড়ন করেছেন সে সমস্তেরই মূল দূরাত্মা কর্ণ।”
ঠ. কৃষ্ণ:
মহাভারতে সবচেয়ে রহস্যময় পুরুষ কৃষ্ণ। বহু হস্তক্ষেপের ফলে তাঁর চরিত্রেই বেশি অসংগতি ঘটেছে। মূল মহাভারতের রচয়িতা কৃষ্ণকে ঈশ্বর বললেও সম্ভবত তাঁর আচরণে অতিপ্রাকৃত ব্যাপার বেশি দেখান নি। সাধারণত তাঁর আচরণ গীতাধর্ম ব্যাখ্যাতারই যোগ্য। কিন্তু মাঝে মাঝে তাঁর যে বিকার দেখা যায় তা ধর্মসংস্থাপক পুরুষোত্তমের পক্ষে নিতান্ত অশোভন, যেমন ঘটোৎকচবধের পর তাঁর উদ্দাম নৃত্য এবং দ্রৌণবধের উদ্দেশ্যে যুধিষ্ঠিরকে মিথ্যাভাষণের উপদেশ। মহাভারত পাঠে বোঝা যায় কৃষ্ণের ঈশ্বরত্ব বহুবিদিত ছিল না।
কৃষ্ণপুত্র শাম্ব দুর্যোধনের জামাতা; দুর্যোধন তাঁর বৈবাহিককে ঈশ্বর মনে করতেন না। সর্বত্র ঈশ্বররূপে স্বীকৃত না হলেও কৃষ্ণ বহু সমাজে অশেষ শ্রদ্ধা ও প্রীতির আধার ছিলেন এবং রূপ শৌর্য বিদ্যা ও প্রজ্ঞার জন্য পুরুষ-শ্ৰেষ্ঠ গণ্য হতেন। তিনি রাজা নন, যাদব অভিজাততন্ত্রের একজন প্রধান মাত্র, কিন্তু প্রতিপত্তিতে সর্বত্র শীর্ষস্থানীয়। তথাপি কৃষ্ণদ্বেষীর অভাব ছিল না।
মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের একটি পুরনো চিত্র
৪. মহাভারতের সময়কার সমাজ:
মহাভারত পাঠে প্রাচীন সমাজ ও জীবনযাত্রার যে পরিচয় পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় সবাই প্রচুর মাংসাহার করতেন। ভদ্রসমাজে মদ্যপান প্রচলিত ছিল। গোমাংসভোজন ও গোমেধ যজ্ঞের বহু উল্লেখ পাওয়া যায়। অস্পৃশ্যতা ছিল কম, দাসদাসীরা অন্ন পরিবেশন করত। মহাভারতের সর্বত্রই যুবতীবিবাহ দেখা যায়। রাজাদের অনেক পত্নী এবং দাসী বা উপপত্নী থাকত। বর্ণসংকরত্বের ভয় ছিল, কিন্তু সংকরবর্ণের লোক ছিল প্রচুর। অনেক বিধবা সহমৃতা হতেন, আবার অনেকে পুত্রপৌত্রাদির সঙ্গে থাকতেন।
নারীর মর্যাদার অভাব ছিল না, কিন্তু সময়ে সময়ে তাঁদেরও দানবিক্রয় এবং জুয়াখেলায় পণ রাখা হতো। ভূমি, ধনরত্ন, বস্ত্র, যানবাহন প্রভৃতির সঙ্গে রূপবতী দাসীও দান করার প্রথা ছিল। উৎসবে শোভাবৃদ্ধির জন্য বেশ্যা নিযুক্ত হতো। ব্রাহ্মণরা প্রচুর সম্মান পেতেন। কিন্তু তারা তুমুল তর্ক করতেন বলে লোকে তাদের উপহাসও করত। দেবপ্রতিমার পূজা প্রচলিত ছিল। রাজাকে দেবতুল্য জ্ঞান করা হতো। প্রজারক্ষা করেন না এমন রাজাকে ক্ষিপ্ত কুক্কুরের ন্যায় বিনষ্ট করা উচিত বলেও বিশ্বাস করা হতো। অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান ছিল অতি বীভৎস। মহাভারতের কালে নরবলি চলত ।
৫. মহাভারতকালীন যুদ্ধের নিয়মাবলি:
যুদ্ধের নিয়মাবলিতে দেখা যায় নিরস্ত্র বা বাহনচ্যুত শত্রুকে মারা অন্যায় বলে গণ্য হতো। নিয়মলঙ্ঘন করলে যোদ্ধা নিন্দাভাজন হতেন। স্বপক্ষ বা বিপক্ষের আহত যোদ্ধাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল। সূর্যাস্তের পর অবহার বা যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হতো। অবশ্য সময়ে সময়ে রাত্রিকালেও যুদ্ধ চলত। যুদ্ধ হতো নির্দিষ্ট সময় ও স্থানে। যুদ্ধভূমির নিকট বেশ্যাশিবির থাকত । বিখ্যাত যোদ্ধাদের রথে চার ঘোড়া জোতা হতো। ধ্বজদণ্ড রথের ভিতর থেকে উঠত, রথী আহত হলে ধ্বজদণ্ড ধরে নিজেকে সামলাতেন।
অর্জুন ও কর্ণের রথ শব্দহীন ছিল। দ্বৈরথ যুদ্ধের পূর্বে বাগযুদ্ধ হতো। বিপক্ষের তেজ কমাবার জন্য দুই বীর পর পরকে গালি দিতেন এবং নিজের গর্ব করতেন। বিখ্যাত রথীদের চতুর্দিকে রক্ষী যোদ্ধারা থাকতেন। পিছনে একাধিক শকটে রাশি রাশি শর ্যান্য ক্ষেপণীয় অস্ত্র থাকত। মনে হয় পদাতিক সৈন্য ধনুর্বাণ নিয়ে যুদ্ধ করতো না। তাদের বর্মও থাকত না। এই কারণেই রথারোহী বর্মধারী যোদ্ধা একাই বহু সৈন্য শরাঘাতে বধ করতে পারতেন।
৬. মহাভারতে ঘটনাগত অসংগতি:
প্রাচীনকালে প্রচলিত বিভিন্ন কিংবদন্তী যোজনার ফলে মহাভারতে প্রচুর ঘটনাগত ও চরিত্রগত অসংগতি দেখা যায়। বহু রচয়িতার হস্ত ক্ষেপ সম্ভবত এর একটি কারণ। দেখা যাচ্ছে মহামতি দ্রোণাচার্য একলব্যকে তার আংগুল কেটে দক্ষিণা দিতে বলছেন, অর্জুন তাতে খুশি। জতুগৃহ থেকে পালাবার সময় পাণ্ডবরা বিনা দ্বিধায় এক নিষাদী ও তার পাঁচ পুত্রকে পুড়ে মরতে দেন। দুঃশাসন যখন চুল ধরে দ্রৌপদীকে দ্যূতসভায় টেনে নিয়ে এল তখন দ্রৌপদী আকুল হয়ে বললেন,“ভীষ্ম দ্রোণ বিদুর আর রাজা ধৃতরাষ্ট্রের কি প্রাণ নেই? কুরুবৃদ্ধগণ এই দারুণ’ অধর্মাচার কি দেখতে পাচ্ছেন না? প্রত্যুত্তরে ভীষ্ম বললেন, ধর্মের তত্ত্ব অতি সূক্ষ্ম, আমি তোমার প্রশ্নের যথার্থ উত্তর দিতে পারছি না।
বীরশ্রেষ্ঠ কর্ণ অম্লানবদনে যখন দুঃশাসনকে বললেন, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ কর তখন মহাপ্রাজ্ঞ ভীষ্ম আর মহাতেজস্বী দ্রোণ চুপ করে বসে ধর্মের সূক্ষ্ম তত্ত্ব ভাবতে লাগলেন। ভীষ্ম দ্রৌণ কৌরবদের হিতসাধনের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, কিন্তু দুর্যোধনের দুষ্কর্ম সইতেও কি তাঁরা বাধ্য ছিলেন? তাঁদের কি স্বতন্ত্র হয়ে কোনও পক্ষে যোগ না দিয়ে থাকবার উপায় ছিল না? মহাভারতে এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না। যুদ্ধারম্ভের পূর্বক্ষণে যখন যুধিষ্ঠির ভীষ্মের পদস্পর্শ করে আশীর্বাদ ভিক্ষা করলেন তখন ভীষ্ম জানালেন – কৌরবগণ অর্থ দিয়ে আমাকে বেঁধে রেখেছে, তাই আমি পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করতে পারি না।
দ্রোণ ও কৃপও অনুরূপ কথা বলেছেন। এদের মর্যাদাবুদ্ধি বা code of conduct পাঠকের পক্ষে বোঝা কঠিন। এরা কেউ পাণ্ডবদের প্রতি পক্ষপাত গোপন করেন না, অথচ যুদ্ধকালে পাণ্ডবদের বহু নিকট আত্মীয় ও বন্ধুকে তাঁরা অসংকোচে বধ করেছেন।
৭. মহাভারত স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক ঘটনার বিচিত্র সংমিশ্রণ:
রাজশেখর বসুর মতে মহাভারতকথা স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক ঘটনার বিচিত্র সংমিশ্রণ। পড়তে পড়তে মনে হবে আমরা এক স্বপ্নলোকে উপস্থিত হয়েছি। সেখানে দেবতা আর মানুষের মধ্যে অবাধে মেলামেশা হচ্ছে। ঋষিরা হাজার হাজার বৎসর ধরে তপস্যা করছেন এবং মাঝে মাঝে অপ্সরার পালায় পড়ে নাকাল হচ্ছেন। সেখানে যজ্ঞ করাই রাজাদের সবচেয়ে বড় কাজ। বিখ্যাত বীরগণ যেসকল অস্ত্র নিয়ে লড়েন তার কাছে আধুনিক অস্ত্র তুচ্ছ। লোকে কথায় কথায় শাপ দেয়। এই শাপ ইচ্ছা করলেও প্রত্যাহার করা যায় না।
স্ত্রীপুরুষ অসংকোচে তাদের কামনা ব্যক্ত করে। পুত্রের এতই প্রয়োজন যে ক্ষেত্রজ (অন্যের ঔরসে) পুত্র পেলেও লোকে কৃতার্থ হয়। কিছুই অসম্ভব গণ্য হয় না। গরুড় গজকচ্ছপ খান, এমন সরোবর আছে যাতে অবগাহন করলে পুরুষ স্ত্রী হয়ে যায়। বসু আরও লিখছেন, মনুষ্যজন্মের জন্য নারীগর্ভ অনাবশ্যক, মাছের পেট, শরের ঝোপ বা কলসীতেও জরায়ুর কাজ হয়। কৃষ্ণের ঈশ্বরত্ব পাকা করবার জন্য মহাভারতের স্থানে অস্থানে তাঁকে দিয়ে কেউ কেউ অনর্থক অলৌকিক লীলা দেখিয়েছেন, কিংবা কুটিল বা বালকোচিত অপকর্ম করিয়েছেন।
মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের একটি পুরনো খোদাইকর্ম
কেউ সুবিধা পেলেই মহাদেবের মহিমা কীর্তন করে তাঁকে কৃষ্ণের উপরে স্থান দিয়েছেন; কেউ বা গো-ব্রাহ্মণের মাহাত্ম্য, ব্রত-উপবাসাদির ফল বা স্ত্রীজাতির কুৎসা প্রচার করেছেন, কেউ বা আষাঢ়ে গল্প জুড়ে দিয়েছেন। বঙ্কিমচন্দ্র উত্ত্যক্ত হয়ে ‘কৃষ্ণচরিত্র’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘এ ছাই ভস্ম মাথামুণ্ডের সমালোচনা বিড়ম্বনা মাত্র। তবে এ হতভাগ্য দেশের লোকের বিশ্বাস যে যাহা কিছু পুঁথির ভিতর পাওয়া যায় তাই ঋষিবাক্য, অভ্রান্ত, শিরোধার্য। কাজেই এ বিড়ম্বনা আমাকে স্বীকার করিতে হইয়াছে।”
৮. মহাভারত সংগ্রগ্রন্থ বা কাব্য নয়, জাতির ইতিহাস:
মহাভারতকে সংহিতা অর্থাৎ সংগ্রহ গ্রন্থ বলা হয়। কেউ কেউ একে পঞ্চম বেদ অর্থাৎ ধর্মগ্রন্থ হিসেবে অভিহিত করে। প্রাচীন খণ্ড খণ্ড আখ্যান ও ঐতিহ্য সংগ্রহ করে মহাভারত সংকলিত হয়েছে । এতে ভগবদগীতা প্রভৃতি দার্শনিক সন্দৰ্ভ আছে। মহাভারত অতি প্রাচীন সমাজ ও নীতি বিষয়ক তথ্যের অনন্ত ভাণ্ডার। পরলোক প্রভৃতি সম্বন্ধে প্রাচীন ধারণা কী ছিল তাও এই গ্রন্থ থেকে জানা যায়। প্রচুর কাব্যরস থাকলেও মহাভারতকে মহাকাব্য বলা হয় না, ইতিহাস নামেই এই গ্রন্থ প্রসিদ্ধ। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘ইহা কোনও ব্যক্তিবিশেষের রচিত ইতিহাস নহে, ইহা একটি জাতির স্বরচিত স্বাভাবিক ইতিহাস।’
৯. মহাভারতে ভূমিপুত্রদেরই (অন-আর্য) জয়জয়কার:
মহাভারত লোকের কাছে ভরতবংশের ইতিহাস বলে খ্যাত। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায় মহাভারত প্রকৃতপক্ষে সত্যবতী-দ্বৈপায়ন বংশের ইতিহাস। কে এই সত্যবতী ও দ্বৈপায়ন? সত্যবতী হচ্ছেন মহাভারতের রচয়িতা (প্রকৃতপক্ষে সংকলক) ব্যাসদেবের মাতা। সত্যবতীর কাহিনী পাঠ করলেই জানা যাবে মহাভারতের রচয়িতার জন্ম কাহিনী ও মহাভারতের অন্যতম প্রধান চরিত্র ভীষ্ম, ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর কাহিনী। সুধীর চন্দ্র সরকারের ‘পৌরাণিক অভিধানে’ সত্যবতীর কাহিনীটি এভাবে লিপিবদ্ধ আছে:
চেদি-রাজ উপরিচর বসু একদা মৃগয়াকালে তাঁর রূপবতী স্ত্রী গিরিকাকে স্মরণ করে কামাবিষ্ট হন এবং তাঁর স্খলিত শুক্র এক শ্যেনকে দিয়ে রাজমহিষীর নিকট প্রেরণ করেন। পথে অন্য এক শ্যেনের আক্রমণে এই শুক্র যমুনার জলে পড়ে ও ব্রহ্মশাপে মৎসীরূপিণী অদ্রিকা নামে এক অপ্সরা এই জল পান করে গর্ভবতী হয় এবং দশম মাসে এক ধীবর কর্তৃক ধৃত হয়। ধীবর এই মৎসীর উদরে একটি পুরুষ ও একটি কন্যাশিশু পায় ও মৎসী শাপমুক্ত হয়। পুত্রের নাম হয় মৎস্য ও কন্যার নাম সত্যবর্তী। কিন্তু কন্যার গাত্রে মৎস্যের গন্ধ প্রবল ছিল বলে এর নাম হয় মৎস্যগন্ধা।
বসুরাজের এই কন্যা ধীবরপালিতা হয়ে যৌবনে যমুনায় খেয়া পারাপারের কাজ করতেন। একদা তীর্থ পর্যটনরত পরাশর মুনি এঁর নৌকায় উঠে এঁর অপরূপ সৌন্দর্যে আসক্ত হয়ে তাঁর কাছে এক পুত্র প্রার্থনা করেন, এবং কুজ্ঝটিকা সৃষ্টি করে নদীর মধ্যে তাঁর সহিত সঙ্গম করেন। পরাশরের ঔরসে সদ্য গর্ভধারণ করে সত্যবতী কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসকে প্রসব করেন। পরাশরের বরে পুত্র প্রসবের পরেও সত্যবতী কুমারীই থাকেন ও তাঁর দেহ সুগন্ধময় হওয়াতে তাঁর নাম হয় গন্ধবতী। এক যোজন দূর হতে তাঁর দেহের সুগন্ধ পাওয়া যেত বলে তাঁকে যোজন-গন্ধাও বলা হত।
একদা হস্তিনাপুরের রাজা শান্তনু যমুনা তীরবর্তী বনে ভ্রমণ করবার সময়ে এঁর গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে এঁকে দেখে ও পরিচয় পেয়ে এঁর পালক পিতা দাসরাজার নিকট কন্যাকে প্রার্থনা করেন। দাসরাজের শর্ত ছিল যে, সত্যবতীর গর্ভজাত সন্তানকে রাজ্য দান করতে হবে। শান্তনু এই কথা শুনে অসম্মত হলেন; কারণ তার জ্যেষ্ঠ পুত্র ভীষ্মকেই তিনি রাজ্যদান করবেন বলে মনস্থ করেছিলেন। কিন্তু এই কথা শোনার পর ভীষ্ম তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র হয়েও সিংহাসনের অধিকার ত্যাগ করে পিতার ইচ্ছা পূরণ করেন।
সত্যবর্তী ও শান্ত নুর বিবাহের ফলে চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য নামে দুই পুত্রের জন্ম হয়। কনিষ্ঠ পুত্র যৌবন লাভ করার পূর্বেই শান্তনুর মৃত্যু হয়। ভীষ্ম সত্যবতীর মতানুসারে চিত্রাঙ্গদকে রাজ পদে প্রতিষ্ঠিত করেন। চিত্রাঙ্গদ গন্ধর্বরাজের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হলে বিচিত্রবীর্য রাজা হন। তাঁর সহিত কাশীরাজের কন্যা অম্বিকা ও অম্বালিকার বিবাহ হয়; কিন্তু সাত বৎসর পরে বিচিত্রবীর্যের যক্ষ্মারোগে মৃত্যু হয়। পুত্রশোকার্তা সত্যবতী তাঁর দুই বধূকে সান্তনা দানের পর রাজ্য ও বংশ-রক্ষার জন্য ভীষ্মকে ভ্রাতৃবধূদের গর্ভে সন্তান উৎপাদন করতে বলেন, নতুবা বিবাহ করে স্বয়ং রাজা হতে বলেন।
ভীষ্ম পূর্ব প্রতিজ্ঞা স্মরণ করে সত্যবতীর কথায় অসম্মত হলে তিনি তাঁর কুমারী কালে জাত পুত্ৰ কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসকে আহ্বান করেন এবং মাতার নির্দেশে দ্বৈপায়ন অম্বিকা ও অম্বালিকার গর্ভে ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুকে উৎপাদন করেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ আরম্ভ হবার পূর্বে পুত্র ব্যাসদেবের প্রেরণায় সত্যবতী বনবাসিনী হয়ে তপশ্চর্যায় নিযুক্ত থাকেন। এইভাবে তাঁর শেষ জীবন অতিবাহিত হয়। ওপরের বর্ণনা থেকে দেখা যাচ্ছে সত্যবতীর জন্ম মৎস্যরূপী অপ্সরার গর্ভে। ধীবর কর্তৃক পালিতা তিনি। তাঁর সাথে পরাশর মুনির মিলনের ফল হচ্ছে ব্যাসদেব।
মহাভারতের গল্পের একটি পুরনো খোদাইকর্ম
আবার সত্যবতীর সাথে শান্তনুর রাজার বিয়ের সন্তান হচ্ছে চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য। বিচিত্রবীর্যের স্ত্রী অম্বিকা ও অম্বালিকার সাথে ব্যাসদেবের মিলনের ফসল হচ্ছেন যথাক্রমে ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু। মহাভারতের যুদ্ধের দুইপক্ষ যদি ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর সন্তানগণ হন তাহলে কি এই যুদ্ধটি ব্যাসদেবের নাতিদের মধ্যে হয় না? এবং হয় না কি তা সত্যবতী-ব্যাসের বংশের কাহিনী। এটি অবলোকন করেই প্রতিভা বসু লিখছেন:
সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে বিচার করলে মনে হয়, মহাভারতের গল্প বহিরাগত আর্যশাসকদের বিরুদ্ধে অনার্য, কৃষ্ণবর্ণ, বর্ণসংকর, জাতিবৈষম্যে বিড়ম্বিত দেশবাসীর অন্তিম প্রতিশোধ। শুদ্ধ শোণিতের গরিমালুপ্তির ইতিহাস। হিন্দুধর্মে যতোই জাতবিচারের প্রচলন থাক, ভারতবর্ষের মাটি থেকে যে রক্তের শুদ্ধতা বহু যুগ পূর্বেই ধুয়ে মুছে গেছে, ভরতবংশের এই মহিমান্বিত কাহিনী তার দলিল।
মুনিঋষিই হোন, আর ক্ষত্রিয় রাজা মহারাজাই হোন, এমনকি তথাকথিত দেবতারা পর্যন্ত, সত্যবতী দ্রৌপদীর মতো কৃষ্ণাঙ্গী, রূপযৌবনবতী, অনার্যা রমণীদের চরণে নিজেদের উৎসর্গিত করেছেন। এবং মাতৃশাসিত সমাজের সেই সব প্রবল ব্যক্তিত্বশালিনী নারীদের সম্মোহনের কাছে আর্যপুত্ররা, তপস্বী ব্রাহ্মণেরা, জাতের শুদ্ধতা বিসর্জন দিতে মুহূর্তমাত্র দ্বিধা করেন নি।
জাতের দোহাই দিয়ে একলব্যের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ কেটে নেওয়া অথবা কর্ণকে দ্রৌপদীর প্রত্যাখ্যান, নেহাৎ-ই অর্জুনের স্বার্থে উদ্দেশ্য প্রণোদিত ঘটনা। বহিরাগতদের সঙ্গে আদিনিবাসীদের মিশ্রণ অতি নিবিড় এবং গভীর ছিলো বলেই পেশাভিত্তিক জাতবিচারের প্রয়োজন হয়েছিলো, শোণিতের শুদ্ধতার প্রশ্ন সেখানে অবান্তর।
রামায়ণ আর্যদের ভারত জয়ের কাহিনী : ভারতীয় দুই কালজয়ী মহাকাব্যের একটি হচ্ছে রামায়ণ এবং অন্যটি মহাভারত। । যুগ যুগ ধরে রামায়ণ ও মহাভারত অগণিত মানুষের কাছে সমাদৃত হয়ে আসছে। অনেকেই এ দুটো মহাকাব্যকে ধর্মগ্রন্থ হিসেবে গণ্য করেন। তাদের কাছে বেদ নয় রামায়ণ ও মহাভারতই ধর্মগ্রন্থ। মানুষ ধর্মীয় প্রশ্নের উত্তরে এ দুটো গ্রন্থকেই দিক নির্দেশনা হিসেবে গ্রহণ করে। রামায়ণ ও মহাভারতের আদর্শবাদ, কাহিনীর নিপুণ বিন্যাস ও সুললিত ছন্দ যে কোনো পাঠককে স্পর্শ করে। রামায়ণকে দেখা হয় গৃহধর্মের আকর গ্রন্থ হিসেবে। রামায়ণে বিধৃত পিতৃভক্তি, মাতৃভক্তি, ভ্রাতৃভক্তি, সীতার দুঃখময় জীবন, রামভক্তি, হনুমানের বীরত্ব, রাবণ ও মেঘনাদের বীরত্ব, রাবণের অহঙ্কার, সীতার অগ্নিপরীক্ষা, বিভীষণের ভূমিকা, বালী বধ ও শব্দুক বধ ইত্যাদি ঘটনা আজও মানুষের মুখে মুখে।
আর্যদের ভারত জয়ের কাহিনী : রামায়ণ
পণ্ডিতদের দৃষ্টিতে রামায়ণ হচ্ছে বহিরাগত আর্যদের ভারত জয়ের কাহিনী। এ বিজয় যতটা না বীরত্বের মাধ্যমে তার চেয়ে বেশি স্থানীয় কিছু মানুষের সহযোগিতায় যাদের বানর, হনুমান ইত্যাদি বলে চিত্রিত করা হয়। যারা রামায়ণকে আর্যদের বিজয় ইতিহাস বলে মনে করেন তাদের মতে মহাভারত হচ্ছে আর্যদের নিজেদের মধ্যেকার জ্ঞাতিযুদ্ধ ।
উল্লেখ্য রামায়ণ ও মহাভারতের মধ্যে রামায়ণই অধিকতর জনপ্রিয় এবং প্রকৃতপক্ষে এটিই ভারতের জাতীয় মহাকাব্য। ভারতীয় সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দুতে রামায়ণ, মহাভারত নয়। নিচে রামায়ণের সংক্ষিপ্ত একটি পরিচয় তুলে ধরা হল:
১. রামায়ণের রচয়িতা:
মহর্ষি বাল্মীকি রামায়ণের রচয়িতা বলে পরিচিত। তাঁর প্রকৃত নাম রত্মাকর। পেশায় ডাকসাইটে দস্যু। জীবনের এক পর্যায়ে তিনি ঋষিতে উন্নীত হন। বিশ্বাস করা হয় তিনি নারদের কাছ থেকে রামের বৃত্তান্ত শুনেন। ব্রহ্মার নির্দেশে বাল্মীকি সংস্কৃত ভাষায় রামায়ণ রচনা করেন। ব্রহ্মার বরেই তিনি কবিত্ব লাভ করেন। বিশ্বাস করা হয় শরবিদ্ধ পাখিকে দেখে নিজের অজান্তেই বাল্মীকির মুখ থেকে বেরিয়ে আসে বিশ্বসাহিত্যের প্রথম শ্লোক বা কবিতা। বাংলাভাষীদের কাছে কৃত্তিবাস ওঝার বাংলা রামায়ণ জনপ্রিয়।
মুষ্কিল হচ্ছে অনুবাদের সময় তিনি নিজে বেশ কিছু সংযোজন করেন। যেমন রামের দুর্গোৎসবের প্রসঙ্গ। এটি মূল বাল্মীকি রামায়ণে নেই। কিন্তু কৃত্তিবাসী বাংলা রামায়ণে আছে। এদিকে তুলসীদাসের রামচরিতমানসের (বাংলা রামায়ণ) সঙ্গেও বাল্মীকি রামায়ণের বেশ কিছু গড়মিল আছে। এ সূত্রেই প্রশ্ন ওঠে বাংলা রামায়ণে যদি এমন সংযোজন হয়ে থাকে তাহলে বাল্মীকির নামে চালু রামায়ণে যে এ ঘটনা ঘটে নি তার নিশ্চয়তা কি? বিশেষ করে যখন এ মহাকাব্যটি কয়েক শো বছর ধরে রচিত হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বলা দরকার বিভিন্ন অঞ্চলে ও বিভিন্ন দেশে নানা রকমের রামায়ণ আছে। এসবের মধ্যে অনেক বড় বড় গড়মিলও লক্ষণীয়। এমতাবস্থায় এ কথা বলা কঠিন মূল রামায়ণ কতটুকু, আর কতটুকু অন্যান্যদের সংযোজন বা প্রক্ষিপ্ত। অনেকের মতে রামায়ণের উত্তরকাণ্ড মূল রামায়ণে নেই। বাল্মীকি রাম-সীতাকে অযোধ্যায় ফিরিয়ে এনে রামকে সিংহাসনে বসিয়েই রামায়ণ শেষ করেন। তিনি সীতাকে নির্বাসনে পাঠান নি।
২. রামায়ণের রচনাকাল:
ড. সুকুমারী ভট্টাচার্যের মতে প্রাচীন ভারত সমাজ ও সাহিত্য: আনন্দ পাবলিশার্স প্রা: লি: কলকাতা) রামায়ণ খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় বা দ্বিতীয় থেকে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতকের মধ্যে রচিত হয়। এদিকে মহাভারত রচনা শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম বা চতুর্থ শতকে এবং রচনা শেষ হয় খ্রিস্টীয় চতুর্থ বা পঞ্চম শতকে। অর্থাৎ রামায়ণ পরে শুরু হয়ে আগে শেষ হয় এবং মহাভারত আগে শুরু হয়ে পরে শেষ হয়। এ জন্যই রামায়ণকে আদি মহাকাব্য বলা হয়। এখানে উল্লেখ্য দুটোরই রচনাকাল বুদ্ধের-পরবর্তী কাল।
৩. রামায়ণের আকার:
রামায়ণে ৪০,০০০ এরও বেশি শ্লোক আছে। এ শ্লোকগুলো সপ্তকাণ্ডে বিন্যাস করা যেজন্য বলা হয় সপ্তকাণ্ড রামায়ণ রামায়ণের কলেবর মহাভারতের এক-চতুর্থাংশ। মূল বাল্মীকি রামায়ণে অবশ্য ২৪০০০ শোক আছে।
৪. রামায়ণের সংক্ষিপ্ত কাহিনী:
রামায়ণ কাহিনীর সংক্ষিপ্ত ও একটি সুন্দর বর্ণনা দেওয়া আছে বিষ্ণুপদ চক্রবর্তীর গ্রন্থে (রামায়ণ আনন্দ পাবলিশার্স প্রা: লি: কলকাতা, ১৯৯৮)। চক্রবর্তীর ভাষায় বিভিন্ন কাণ্ডে সাজানো বর্ণনাটি হুবহু নিম্নরূপ:
ক. বালকাণ্ড:
অযোধ্যার ইক্ষাকু বংশীয় রাজা দশরথের তিন রানি। কৌশল্যা, কৈকেয়ী আর সুমিত্রা। কোনও ছেলে নেই। পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করলেন দশরথ। চার ছেলে হল। কৌশল্যার গর্ভে রাম, কৈকেয়ীর গর্ভে ভরত, আর সুমিত্রার গর্ভে দুই যমজ ছেলে, লক্ষ্মণ আর শত্রুঘ্নের জন্ম হল।
রাক্ষস মারীচ আর সুবাহুকে বধ করার জন্য রামকে নিয়ে যেতে, দশরথের রাজসভায় এলেন ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্র। অনিচ্ছাসত্ত্বেও, বৈশিষ্ঠের পরামর্শে, সম্মতি দিলেন দশরথ। রাম-লক্ষ্মণকে নিয়ে চললেন বিশ্বামিত্র। পথে ভয়ঙ্কর তাড়কা রাক্ষসীকে বধ করলেন রাম। বিশ্বামিত্রের আশ্রমে যজ্ঞে বাধা দিতে এসে, রামের বাণে ধরাশায়ী হলেন সুবাহু। মারীচ গিয়ে পড়লেন এক শো যোজন দূরের সমুদ্রে। মিথিলায় ঢুকেই, গৌতম মুনির আশ্রমে শাপগ্রস্তা পাষাণী অহল্যাকে শাপমুক্ত করলেন রাম।
মিথিলার রাজা জনকের পালিতা মেয়ে সীতা জনক ঘোষণা করলেন, যে ‘হরধনু’ তে শর জুড়তে পারবে, তার গলায় সীতা মালা দেবে। রাম ভাঙলেন সেই হরধনু। রামের গলায় মালা দিলেন সীতা জনকের নিজের মেয়ে ঊর্মিলার সঙ্গে বিয়ে হল লক্ষ্মণের। জনকের ভাই কুশধ্বজের দুই মেয়ে মাণ্ডবী আর শ্রুতকীর্তি মালা দিলেন যথাক্রমে ভরত আর শত্রুঘ্নের গলায় পরশুরামের দর্প ছিল, তাঁর ‘বিষ্ণুধনু’তে কেউ জ্যা আরোপ করতে পারবে না। সে দর্প চূর্ণ করলেন রাম। সবাই মিলে ফিরে এলেন অযোধ্যায় রাম অযোধ্যার সবার নয়নের মণি হয়ে উঠলেন।
খ. অযোধ্যাকাণ্ড:
দশরথের আদেশে, রামকে যুবরাজ পদে অভিষিক্ত করার আয়োজন শুরু হল। কুব্জা দাসী মন্থরা কৈকেয়ীর মন বিষিয়ে দিল। দশরথের কাছে প্রাপ্য দুই বর চেয়ে নিলেন কৈকেয়ী। এক বরে, ভরতকে রাজা করতে হবে। দ্বিতীয় বরে, রামকে চোদ্দো বছরের জন্য বনবাসে যেতে হবে।
ভরত আর শত্রুঘ্ন ছিলেন মামার বাড়িতে। ফিরে এসে সব শুনে রেগেই আগুন। চিত্রকুটে গিয়ে ভরত কেঁদে জড়িয়ে ধরলেন রামের দু’পা রাম কিছুতেই ফিরতে রাজি হলেন না রামের পাদুকা মাথায় নিয়ে এসে, অযোধ্যার সিংহাসনে বসিয়ে রামের প্রতিনিধি হয়ে, রাজকার্য দেখা শোনা করতে লাগলেন ভরত।
গ. অরণ্যকাণ্ড:
দণ্ডকারণ্যে এলেন রাম-লক্ষ্মণ-সীতা। রাক্ষস বিরাধকে বধ করলেন রাম অগস্ত্য মুনির পরামর্শে, চললেন পঞ্চবটী। পথে দশরথের বন্ধু জটায়ুর সঙ্গে পরিচয় হল। লঙ্কার রাক্ষস-রাজা রাবণের বিধবা বোন শূর্পণখা সুন্দরী নারীর রূপ ধরে এসে প্রথমে রামকে, তারপর লক্ষ্মণকে বিয়ে করতে চাইলেন। শূর্পণখার নাক আর কান কেটে দিলেন লক্ষ্মণ।
প্রতিশোধ নিতে, শূর্পণখা ছুটলেন দাদা রাবণের কাছে। রাবণের আদেশে, খর, দূষণ আর ত্রিশিরা নামের তিন রাক্ষস মহাবীর ছুটে এলেন পঞ্চবটীতে। তিনজনকেই যমালয়ে পাঠালেন রাম। রাক্ষস অকম্পনের পরামর্শে, সীতাকে অপহরণ করার চক্রান্ত করলেন রাবণ। মারীচকে মায়ামৃগের রূপ ধারণ করে পঞ্চবটীতে ঘুরে বেড়াতে আদেশ করলেন। রাবণের ফাঁদে কাজ হল। ‘সোনার হরিণ চাই’-বায়না ধরলেন সীতা।
রাম চললেন হরিণকে ধরতে। মারীচ রামের গলা নকল করে আর্ত চিৎকার করলেন। রামের বিপদের আশঙ্কায় সীতা লক্ষ্মণকে পাঠালেন রামকে ফেরাতে। সেই সুযোগে সন্ন্যাসীর ভেক ধরে রাবণ এসে হরণ করলেন সীতাকে লঙ্কায় নিয়ে চললেন। পুষ্পক রথে।
পথে জটায়ুর সঙ্গে রাবণের ঘোরতর লড়াই হল। রাবণ জটায়ুর ডানা কেটে দিলেন। রাম লক্ষ্মণ সীতার খোঁজে বেরিয়ে মুমূর্যু জটায়ুর কাছ থেকে সব শুনলেন।
শুরু হল পাগলের মতো সীতাকে খোজা। পথে কবন্ধকে বধ করলেন রাম। কবন্ধ দিলেন। সুগ্রীবের খবর।
পম্পা সরোবরের তীরে মতঙ্গ মুনির আশ্রমে রামের প্রতীক্ষায় দিন গুনছিলেন বৃদ্ধা তাপসী শবরী। তাঁকে দেখা দিলেন রাম। তারপর চললেন সুগ্রীবের খোজে।
ঘ. কিস্কিন্ধ্যাকাণ্ড:
বানররাজ সুগ্রীবের সঙ্গে বন্ধুত্ব হল রামের। সুগ্রীব কথা দিলেন, সীতাকে খুঁজে বার করবেন। রাম কথা দিলেন, সুগ্রীবের দাদা বালীকে বধ করে, তাঁর কাছ থেকে রাজ্য আর সুগ্রীবের স্ত্রী রুমাকে আবার ফিরিয়ে দেবেন সুগ্রীবের কাছে। কথা রাখলেন রাম সুগ্রীব কিন্তু নিজের প্রতিজ্ঞার কথা ভুলেই গিয়েছিলেন।
লক্ষ্মণের ভয়ে শুরু করলেন জোরদার সীতাঅন্বেষণ। জটায়ুর দাদা সম্পাতির কাছ থেকে সীতার সুলুক-সন্ধান পেলেন বালীর ছেলে অঙ্গদ। ঠিক হল, হনুমান যাবেন লঙ্কায়।
ঙ. সুন্দরকাণ্ড:
মহেন্দ্র পর্বতের মাথা থেকে এক মহালাফ দিলেন মহাবীর হনুমান। এক লাফেই সাগরপার। এলেন লঙ্কায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর, সীতাকে দেখতে পেলেন অশোক বনে। সীতাকে প্রণাম করে, রাম নাম লেখা রামের আংটি সীতার হাতে তুলে দিলেন হনুমান। সীতাও আঁচল থেকে একটা গয়না বার করে হনুমানের হাতে দিলেন, রামকে দেওয়ার জন্য।
সীতাকে উদ্ধারের নিশ্চিত আশ্বাস দিয়ে হনুমান ফিরে এলেন। সীতার খবর পেয়ে অনেকটা আশ্বস্ত হলেন রাম-লক্ষ্মণ। বানররা আনন্দে হই-চই লাগিয়ে দিল।
চ. লঙ্কাকাণ্ড (যুদ্ধকাণ্ড):
যুদ্ধযাত্রার তোড়জোড় শুরু করলেন রাম। এ দিকে, রাবণের ধর্মভীরু ভাই বিভীষণ সীতাকে রামের কাছে ফিরিয়ে দিতে অনেক অনুরোধ করলেন দাদাকে। ব্যর্থ, অপমানিত হয়ে, বিভীষণ যোগ দিলেন রামের পক্ষে। বানরদের ইঞ্জিনিয়ার নল বানর আর ভলুকদের সাহায্যে বড় বড় পাথরের চাঁই আর বড় বড় গাছ দিয়ে, সাগরের ওপর দিয়ে লঙ্কা পর্যন্ত সেতু তৈরি করে ফেললেন।
রাবণের দুই গুপ্তচর, শুক আর সারণ, রাবণকে গিয়ে সব খবর দিলেন। সুগ্রীব দূর থেকে রাবণকে দেখতে পেয়েই, চড়-কিল-ঘুষিতে রাবণকে ব্যতিব্যস্ত করে আবার রামের কাছে ফিরে এলেন। অঙ্গদও একবার গিয়ে শাসিয়ে দিয়ে এলেন রাবণকে।
সাঙ্ঘাতিক যুদ্ধ করলেন রাবণের বীরপুত্র ইন্দ্রজিৎ। মেঘের আড়াল থেকে নাগপাশে অচেতন করে ফেললেন রাম-লক্ষ্মণকে। খবর পেয়ে সাপের যম গুরুড় ছুটে এলেন সেখানে। ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালাল সব সাপ। চেতনা ফিরে পেলেন রাম-লক্ষ্মণ।
রাম-লক্ষ্মণ আর বানরদের সঙ্গে যুদ্ধে একে একে প্রাণ হারালেন ধূম্রাক্ষ, অকম্পন, প্রহস্ত ইত্যাদি রাক্ষস-পক্ষের রথী-মহারথীরা।
এবার রাবণ নিজেই চললেন যুদ্ধে। সঙ্গে চললেন, ইন্দ্ৰজিৎ, অতিকায়, মহোদর, কুম্ভ, নিকুম্ভ ইত্যাদি বীররা।
হনুমানের ঘুষিতে সংজ্ঞা হারালেন রাবণ। রাবণের শক্তিশেলে সংজ্ঞা লোপ হল লক্ষ্মণের । সেদিনের যুদ্ধে নাস্তানাবুদ হয়ে ফিরে গেলেন রাবণ। রাবণের ভাই কুম্ভকর্ণকে অসময়ে ঘুম থেকে টেনে তোলা হল। অসীম বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে রামের হাতে প্রাণ দিলেন কুম্ভকর্ণ ।
পরদিন। এলেন ইন্দ্রজিৎ। তাঁর তীরে অচৈতন্য হলেন রাম-লক্ষ্মণ। জাম্ববানের আদেশে, হনুমান ঔষধিপর্বত থেকে মৃতসঞ্জীবনী, বিশল্যকরণী, সাবর্ণকরণী আর সন্ধানী এই চার ঔষধের গাছ আনতে গেলেন। ঔষধের গাছ চিনতে না পারায় হনুমান গোটা পর্বতটাই মাথা করে নিয়ে এলেন। ঔষধের গন্ধে রাম-লক্ষণসহ সব বানর সেনা সংজ্ঞা ফিরে পেলেন।
বিভীষণের পরামর্শে, নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে লক্ষ্মণ বধ করলেন অসহায় ইন্দ্রজিৎকে। এবার রাবণ নিজেই এলেন যুদ্ধে তাঁর শক্তিশেলে লক্ষ্মণের বুক বিদীর্ণ হল। সবাই ভাবলেন, লক্ষ্মণ মারা গেছেন। কান্নায় ভেঙে পড়লেন রাম। বানরদের ডাক্তার সুষেণের পরামর্শে, হনুমান আবার সেই ঔষধির গন্ধমাদন পর্বতশৃঙ্গ তুলে নিয়ে এলেন। বেঁচে উঠলেন লক্ষ্মণ।
রাম-রাবণে ভয়ানক যুদ্ধ শুরু হল। ইন্দ্র স্বর্গ থেকে রথ পাঠিয়ে দিলেন রামকে। রাম যত বার রাবণের মাথা কাটেন, তত বারই সেখানে আবার মাথা গজায়। তখন রাম ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। রাবণ প্রাণ হারালেন।
বিভীষণকে লঙ্কার রাজা করা হল। সীতা রাবণের কাছে এতদিন ছিলেন বলে, রাম লোকনিন্দার ভয়ে তাঁকে ফিরিয়ে নিতে চাইলেন না। আগুনে আত্মাহুতি দিতে চাইলেন সীতা। কিন্তু, আগুন জ্বালতেই, স্বয়ং অগ্নিদেব সীতাকে কোলে করে রামের কাছে ফিরিয়ে দিলেন। বললেন, ‘সীতা অপাপবিদ্ধা! শুদ্ধা! পবিত্রতাস্বরূপিণী!’
সীতাকে নিয়ে অযোধ্যায় ফিরলেন রাম আর লক্ষ্মণ। রাম রাজা হলেন। ভরত হলেন যুবরাজ। অযোধ্যায় আনন্দের বন্যা বয়ে গেল।
ছ. উত্তরকাণ্ড:
সীতাকে নিয়ে কিছু দুষ্ট প্রজার কানাঘুষোর কথা রামের কানে এল। রাম লক্ষ্মণকে আদেশ দিলেন, সীতাকে তমসা নদীর তীরে বাল্মীকি মুনির আশ্রমে রেখে আসতে। বাল্মীকি আশ্রমে সীতার দুই যমজ ছেলে হল কুশ আর লব।
অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করলেন রাম।
কৃত্তিবাসী রামায়ণ মতে, যজ্ঞের ঘোড়াটাকে আটকে রেখে একে একে হনুমানসহ, শত্রুঘ্ন, ভরত, লক্ষ্মণ, রাম সকলকে পরাস্ত করলেন বালক কুশ আর লব। বাল্মীকি মুনির মধ্যস্থতায় সবাইকে মুক্তি দেওয়া হল। এ কাহিনী বাল্মীকি রামায়ণে নেই।
যজ্ঞক্ষেত্রে ঋষিবালকের বেশে লব-কুশ শোনালেন বাল্মীকি রচিত রামায়ণ। বাল্মীকি রামকে জানালেন লব-কুশ এবং সীতার কথা। সীতাকে আবার শুদ্ধতার পরীক্ষা দিতে বলা হল। দুঃখে, ক্ষোভে, মা বসুন্ধরার কোলে, পাতালে ফিরে গেলেন সীতা। কালপুরুষের কৌশলে, রামকে দুর্বাসার আগমন বার্তা দিতে গিয়ে, পূর্বশর্ত মতো লক্ষ্মণকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হল সরযূ নদীতে।
অনুতপ্ত, শোক-বিহ্বল রাম কুশকে কোশল, আর লবকে উত্তর দেশের রাজা করে দিয়ে, নিজেও প্রাণ বিসর্জন দিলেন সরযূর জলে। ভরত আর শত্রুঘ্নও রামের পথই অনুসরণ করলেন।
৫. রামায়ণের চরিত্র পরিচয়:
রামায়ণ পাঠ ও তা বোঝার জন্য এর বিভিন্ন চরিত্র সম্বন্ধে একটি ধারণা থাকা দরকার। এ উদ্দেশ্যে নিচে সমধিক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলোর সংক্ষিপ্ত একটি পরিচয় তুলে ধরা হল:
১. ইক্ষাকু: রামের পূর্বপুরুষ। অযোধ্যায় রাজা। ইক্ষাকু বংশের প্রতিষ্ঠাতা। বৈব-স্বত মনুর ছেলে। মনুর ‘কুৎ’ অথবা ‘হাঁচি’ থেকে এর জন্ম বলে তাঁর নাম ইক্ষাকু ।
২. উর্মিলা: লক্ষ্মণের স্ত্রী। জনকের নিজের মেয়ে।
৩. কুম্ভকর্ণ: রাবণের মেজ ভাই।
৪. কৈকেয়ী: ভরতের মা। দশরথের অন্যতমা প্রধানা স্ত্রী। অন্যমতে দ্বিতীয়া অথবা তৃতীয়া স্ত্রী। কেকয়রাজ অশ্বপতির মেয়ে তাই তাঁর নাম কৈকেয়ী।
৫. জনক: মিথিলার রাজা। প্রকৃত নাম ‘সীরধ্বজ’। ‘জনক’ একটি উপাধি। সীতার পালক পিতা।
৬. দশরথ রামের পিতা। অজ ও ইন্দুমতীর পুত্র। রঘু বংশের আদি পুরুষ রঘুর নাতি। এঁর তিন স্ত্রী কৌশল্যা, কৈকেয়ী ও সুমিত্রা। এ ছাড়া আরও ৩৫০ স্ত্রী ছিল দশরথের।
৭. নারদ: বিখ্যাত দেবর্ষি ব্রহ্মার মানসপুত্র। ভাগবত মতে এক দাসীর গর্ভে জন্ম হয় নারদের। রামায়ণ রচনার মূলে নারদ। নারদই প্রথম বাল্মীকিকে রামের কথা শোনান।
৮. বালী: বানররাজ। সুগ্রীবের দাদা।
৯. বাল্মীকি: আদি কবি। রামায়ণের রচয়িতা। প্রথম জীবনে দস্যু ছিলেন। নাম ছিল রত্নাকর। তার জন্ম সম্বন্ধে নানা কাহিনী প্রচলিত। দস্যুবৃত্তি দ্বারা উপার্জিত অর্থে সংসার চালাতেন। কিন্তু এ পাপের বোঝা বাবা, মা, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা কেউ বহন করতে রাজি না হওয়ায় তিনি দুস্যুবৃত্তি ত্যাগ করেন।
১০. বিভীষণ: রাবণের ছোট ভাই। রামভক্ত।
১১. বিশ্বামিত্র : একজন ব্রহ্মর্ষি। ছিলেন ক্ষত্রিয়, কঠোর তপস্যার দ্বারা তিনি ব্রাহ্মণত্ব লাভ করেন।
১২. ভরত: ভগবান বিষ্ণুর অংশ-অবতার। তিনি বিষ্ণুর চারভাগের একভাগ পান। দশরথ ও কৈকেয়ের পুত্র। রামের ১দিনের ছোট। লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্নের একদিনের বড়। জনকের ভাই কুশধ্বজের মেয়ে মাগুবীর সাথে তার বিয়ে হয় ।
১৩. মেঘনাদ: রাবণ ও তাঁর প্রধানা মহিষী মন্দোদরীর বীর পুত্র।
১৫. রাবণ: লঙ্কার রাজা। বিশ্রবা এবং নিকষার পুত্র। এক মতে ব্রহ্মার নাতির পুত্র। দশ মাথা ছিল বলে তার অন্য নাম দশানন। লঙ্কেশ বা লঙ্কেশ্বরও বলা হয়। তিনি রোজ শিবপূজা করতেন।
১৬. লক্ষ্মণ: দশরথ ও সুমিত্রার দুই যমজ ছেলে লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্নের একজন। বিষ্ণুর অংশ-অবতার অর্থাৎ বিষ্ণুর চারভাগের একভাগ শক্তির অধিকারী ছিলেন।
১৭. লব-কুশ: রাম ও সীতার দুই যমজ সন্তান। এদের জন্ম মহর্ষি বাল্মীকির আশ্রমে।
১৮. শত্রুঘ্ন: দশরথ ও সুমিত্রার পুত্র। বিষ্ণুর অংশ অবতার।
১৯. সীতা: জনকের পালিতা কন্যা। রামের স্ত্রী লব-কুশের মা। রামায়ণের নায়িকা। জনকের মেয়ে বলে জানকী। মিথিলার মেয়ে তাই মৈথিলী’। বিদেহের মেয়ে বলে বৈদেহী। সীতা মানে লাঙলের দাগ ক্ষেতে লাঙলের ফলায় টানা ‘সীতা’য় এঁকে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন বলে জনক এঁর নাম রাখেন সীতা।
রাম সর্বমোট বেঁচে ছিলেন ৬৯ বছর ১মাস ১০দিন। তিনি বিয়ে করেছেন ১৩ বছর বয়সে। বনে গেছেন ২৫ বছর বয়সে। ১৪ বছর বনবাসের পর ফিরে এসে রাজা হয়েছেন ৩৯ বছর বয়সে। রাজত্ব করেছেন ৩০ বছর ১মাস ২০ দিন। বলা হয় তিনি নর-লীলা সাঙ্গ করে বিষ্ণু দেহ ধারণ করেন।
৭. রাম বিষ্ণুর অবতার ছিলেন না :
সুকুমারী ভট্টাচার্যসহ প্রায় সকল গবেষকের মতে আদিকাণ্ডের প্রথমার্ধ ও উত্তরকাণ্ড বাদে রামায়ণের বাকি অংশটাই আদি রামায়ণ। আদি রামায়ণে রাম পরিচিত ‘নরচন্দ্রমা’ হিসেবে। রামকে পরবর্তীকালের সংযোজকরা ‘ব্রাহ্মণ্যধর্মের’ (চার বর্ণ ও চার আশ্রম ভিত্তিক ব্রাহ্মণের স্বার্থরক্ষাকারী ধর্ম) প্রতিভূ হিসেবে বিষ্ণুর অবতার হিসেবে চিত্রায়িত করেন। রামকে বিষ্ণুর অবতার বানিয়ে তাঁকে এবং তাঁর স্ত্রী সীতাকে আদর্শস্থানীয় করে একটা ধর্ম প্রতিষ্ঠার চেষ্টাই রচনাকারেরা করেছেন।
৮. রামায়ণ গৃহধর্মের গ্রন্থ:
রামায়ণের বিষয়বস্তু পর্যালোচনা করলে বোঝা যাবে এতে পারিবারিক কতগুলো মূল্যবোধ গঠনের চেষ্টা করেছেন রচনাকারেরা। কয়েকটি উদাহরণ তুলে দেয়া হল: এর
ক. পিতা হচ্ছেন দেবতুল্য। তার সকল আদেশ ও ইচ্ছা অলঙ্ঘণীয়।
খ. জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হবেন পিতার বিকল্প সুতরাং বড় ভাইয়ের অনুগত থাকা আবশ্যক।
গ. বন্ধুর দাবি রক্ষা করা কর্তব্য।
ঘ. অনুগতদের আশ্রয় দেয়া একটি দায়িত্ব ।
ঙ. দাম্পত্য জীবনে স্বামীই প্রভু। স্ত্রীর ইচ্ছা গৌণ। স্ত্রীর দায়িত্ব স্বামীর সেবা ও তাঁর ইচ্ছা পূরণ করা।
উল্লেখ্য উপরোক্ত মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার জন্য রামায়ণে নানা কাহিনী, উপাখ্যান সংযোজন করা হয়েছে। অলৌকিক অনেক ঘটনা, রূপকথা ইত্যাদিও রামায়ণে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। অলৌকিক ঘটনাগুলোর মধ্যে আছে : গন্ধমাদন, বিশল্য করণীর সাহায্যে যুদ্ধে প্রায় পরাস্ত রাম লক্ষ্মণের সংজ্ঞা ফিরিয়ে আনা, যুদ্ধে মায়াসীতা দেখানো, রামের মুণ্ড দেখানো ও নানা মুনিঋষির ও দেবতাদের হস্তক্ষেপ ইত্যাদি।
৯. বাঙালির রামায়ণ ভিন্ন:
বাঙালির কাছে প্রিয় রামায়ণ হচ্ছে কৃত্তিবাস অথবা তুলসীদাসের রামায়ণ এঁরা বাল্মীকির মূল রামায়ণ থেকে সরে এসে মনের মতো করে রামায়ণ লিখেছেন।
১০. রামায়ণের কিছু তথ্য:
রামায়ণ পাঠে তৎকালীন সমাজের একটা চিত্র পাওয়া যায়। বিষ্ণুপদ চক্রবর্তীর আলোচ্য গ্রন্থ থেকে নিম্নলিখিত তথ্য পাওয়া যায়: ক. রাম-লক্ষণ-সীতা প্রমুখ রাজ পরিবারের সকলেই মাংস খেতেন, মদও পাণ করতেন। রাজা হওয়ার পর প্রমোদ কাননে সীতাকে কোলে বসিয়ে রাম নিজের হাতে করে পবিত্র ‘মেরয়’ মদ পাণ করিয়েছেন। বালির স্ত্রী ‘তারা’ মদ পাণ করতেন। খ. এক পুরুষের যেমন একাধিক স্ত্রী ছিল, তেমনি এক নারীরও একাধিক স্বামী ছিল। গ. লক্ষণ কখনও সীতার মুখ দেখেন নি, দেখেছেন পা। ঘ. রাবণের সৈন্যসংখ্যা ছিল ১০,০০০ কোটি। ঙ. রাম-রাবণের যুদ্ধ চলে ১৭-১৮ দিন। চ. সীতার বিয়ে হয় মাত্র ৬ বছর বয়সে। ছ. রামের সময়ে ছোলা এবং যুগডাল খাওয়া ও দান করা রেওয়াজ ছিল।
১১. তপস্যা করার অপরাধে রামের শুদ্র হত্যা:
রামায়ণ রচয়িতার কাছে ব্রাহ্মণ সন্তানের মূল্য শূদ্রের চেয়ে অনেক বেশি। রামায়ণ বর্ণিত এক ঘটনায় দেখা যায় এক ব্রাহ্মণের ছেলে মারা যায়। সে রামের কাছে এসে অভিযোগ করে যে রাজ্যে পাপকার্য চলছে বিধায় তার ছেলে অকালে প্রাণ হারায়। খুঁজেপেতে দেখা গেল এক শূদ্র-তপস্বী সশরীরে স্বর্গে যাওয়ার জন্য তপস্যা করছে। রাজ্যে এটিই পাপকাজ। রাম তৎক্ষণাৎ শম্বুকের মাথা কেটে ফেলেন। অগস্ত্য মুনি খুশি হয়ে রামকে অনেক দিব্য অলঙ্কার দেন। দেখা যায় শুদ্র হত্যার এই ঘটনাকে রামায়ণ রচয়িতা সমাজের দোহাই দিয়ে গৌরবান্বিত করেছেন।
১২. সীতার পাতাল গমণ ও রামের বিচার:
সীতা অপাপবিদ্ধা, নিষ্কলুষ, নিরপরাধী। রাম যুদ্ধ করে তাঁকে অযোধ্যায় ফেরত আনলেন সত্যি, কিন্তু তাঁকে গ্রহণ করতে চাইলেন না। সীতা অগ্নিতে ঝাঁপ দিলেন। অগ্নিদেব তাঁকে রক্ষা করলেন। রাম তাকে বনবাসে পাঠালেন। সেখানে জন্ম হল লব ও কুশের। সীতাকে আবার সতীত্বের পরীক্ষা দিতে বলা হল। সীতা দুঃখে ক্ষোভে মা বসুধাকে ডেকে পাতালে প্রবেশ করেন। দেখা যাচ্ছে দেবতারা, এমনকি মহাদেব পর্যন্ত সীতার সতীত্ব সম্বন্ধে প্রশংসা করছেন। রাম তবু সীতাকে গ্রহণ করনে নি ।
১৩. রামায়ণ ও মহাভারতের মধ্যে কাহিনীগত মূল পার্থক্য:
রামায়ণের যুদ্ধ হয় রাম ও রাবণের মধ্যে। যুদ্ধের কারণ সীতাহরণ। রাবণ সীতাকে হরণ করেন। রাম যুদ্ধ করে সীতাকে উদ্ধার করেন। এই কাহিনী সকলের বোধগম্য। বিপরীতে মহাভারতের যুদ্ধ এক জটিল সমস্যাকে কেন্দ্র করে। এই যুদ্ধ একই বংশের লোকের মধ্যে যারা ভাই ভাই। বিরোধটি সিংহাসন বা সম্পত্তি লাভের জন্য। দুইভাই ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু। বড় ভাই ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ, তাই জ্যেষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও তিনি সিংহাসনে বসতে পারেন নি। বসেন পাণ্ডু। পাণ্ডুর মৃত্যুতে পাণ্ডু-পুত্র যুধিষ্ঠির সিংহাসনের অধিকারী। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তিনি পাণ্ডুর ঔরসজাত সন্তান নন। এদিকে পাণ্ডুর বড় ভাই ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ হওয়ায় আগেই সিংহাসন থেকে বঞ্চিত। তার পুত্র অর্থাৎ দুর্যোধনাদিরা তাই বঞ্চনার প্রতিকার চান। বিশেষত যেহেতু যুধিষ্ঠির পাণ্ডুর ঔরসজাত নন। অতএব দেখা যাচ্ছে রামায়ণের কাহিনী যত সহজ, মহাভারতের কাহিনী ঠিক ততটুকুই জটিল।
১৪. মূল রামায়ণ একটি ক্ষত্রিয় কাহিনী:
মূল রামায়ণ একটি ক্ষত্রিয় কাহিনী ছিল। শত শত বছর ধরে ব্রাহ্মণরা তাদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার জন্য এতে নানা কল্প কাহিনী সংযোজন করে/ঢুকিয়ে দেয়। এর জন্য তারা নানা অলৌকিক কাহিনী ও উপাখ্যান তৈরি করে। এসবের মাধ্যমে শূদ্রদের হেয় করা হয়, নারীকে অবমূল্যায়িত করা হয়। পাশাপাশি করা হয় ব্রাহ্মণদের মহিমা কীর্তন। সৃষ্টি করা হয় নানা সম্প্রদায় যথা: শৈব, বৈষ্ণব ইত্যাদি। প্রচার করা হয় এটিই হিন্দুর ধর্মগ্রন্থ রচনা করা হয় আরও কুড়িটি ধর্মশাস্ত্র, আঠারোটি পুরাণ ও অসংখ্য উপপুরাণ। এভাবেই পৌরাণিক আমলে তৈরি করা হয় চারবর্ণ ও চার আশ্রম ভিত্তিক একটি ধর্ম যা আজকের দিনে সনাতন ধর্ম/হিন্দুধর্ম নামে পরিচিত। এর কেন্দ্রে স্থাপন করা হয় পরিবর্তিত রামায়ণ ও পরিবর্তিত মহাভারত। ক্ষত্রিয় কাহিনীকে পরিণত করা হয় ধর্মে।
বেদ আছে, কিন্তু বেদ এর দেবতারা টিকেনি : আনুমানিক তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার বছর পূর্বে রচিত বেদ অনেক হিন্দুর আনুমাি । কাছে ধর্মগ্রন্থ। বলা হয় ভগবদ্বিষয়ক জ্ঞানই হচ্ছে বেদ। বিশ্বাস করা হয় বেদের যাগ-যজ্ঞাদি দ্বারা চিত্তশুদ্ধি করে পরম পুরুষকে ডাকলে তাঁকে পাওয়া যায়। এমনও দাবি করা হয় যে বেদই হিন্দুর জীবনকে শতশত বছর যাবত নিয়ন্ত্রণ করে আসছে এবং হিন্দুর ধর্মটি বেদমূলক। অনেকে বেদকে দেখেন সকল জ্ঞানের ভাণ্ডার হিসেবে। বেদ জানা থাকলে আর কোনো জ্ঞানের প্রয়োজন নেই বলেও দাবি করা হয়।
বেদ আছে, কিন্তু বেদ এর দেবতারা টিকেনি
এদিকে দেখা যায় ধর্মগ্রন্থ হিসেবে বেদের গ্রহণযোগ্যতা বরাবরই প্রবল ছিল প্রতিবাদের বিষয়। বেদের বিরুদ্ধে প্রথম বড় প্রতিবাদ বৌদ্ধধর্ম। আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে প্রধানত বেদকে এবং বেদের ধর্মকে অর্থাৎ বৈদিক ধর্ম বা আর্যধর্ম বা ব্রাহ্মণ্যধর্মকে অস্বীকার করেই বৌদ্ধধর্মের যাত্রা শুরু। বেদের দেবতা, সমাজ কাঠামো, জাতিবিন্যাস, যজ্ঞ ও পুরোহিত ইত্যাদি বিশেষ করে ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব অস্বীকার করে বৌদ্ধধর্ম ভারতের জনপ্রিয় এক ধর্মের মর্যাদা লাভ করে। এর কিছুকাল আগে মহাবীরের জৈনধর্মও প্রায় একই অবস্থান নেয়।
বেদ এর দেবতারা টিকেনি
মহাবীর ও গৌতম বুদ্ধের সমসাময়িককালে বেদ, বেদভিত্তিক সমাজ ও চিন্তাবোধ, যজ্ঞ ও পুরোহিত, বিশেষ করে ব্রাহ্মণ্য সমাজের বিরুদ্ধে কঠোরতম অবস্থান নেন বিখ্যাত ভারতীয় দার্শনিক চার্বাক। তাঁর দর্শন চার্বাক দর্শন হিসেবে পরিচিত। বৌদ্ধ ও চার্বাক দর্শন যেহেতু বেদবিরোধী তাই এই দর্শন দুটোকে বেদপন্থীরা নাস্তিক দর্শন হিসেবে আখ্যায়িত করে। আর বৌদ্ধরা পরিচিত হয় ‘নাস্তিক’ হিসেবে। বিপরীতে বেদে বিশ্বাসীরাই পরিচিতি লাভ করে ‘আস্তিক’ হিসেবে।
একদিকে আর্যধর্ম/বৈদিকধর্ম / ব্রাহ্মণ্যধর্ম এবং অন্যদিকে লোকায়ত ধর্ম ও বিশ্বাস, জৈন-বৌদ্ধধর্ম ও চার্বাক দর্শনের সংঘাত-সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটে সংঘটিত সমাজ-বিপ্লবের এক পর্যায়ে বৌদ্ধধর্ম নির্জীব হয় এবং রচিত হয় পৌরাণিক ধর্মের প্রেক্ষাপট। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ-সপ্তম শতাব্দীতে সূচনা ঘটে পৌরাণিক ধর্মের। এ ধর্মের ভিত্তি হচ্ছে বিভিন্ন পুরাণ কাহিনী। একে বলা যায় ব্রাহ্মণ্যধর্মের বা বেদভিত্তিক ধর্মের পুনরুত্থান। এই পুন রুত্থানকালেই বিভিন্ন পুরাণ রচিত হয়। উদ্দেশ্য আর্যধর্ম ও দেশজ ধর্মের সমন্বয় সাধন করা।
এটি করতে গিয়ে ব্রাহ্মণ্য সমাজ তাদের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য একদিকে যেমন নানা কল্পকাহিনীর আশ্রয় নেয়, পুরোনো কাহিনীগুলোকে নিজের মত করে লিখে, তেমনি তাদেরকে অনেক বড় বড় ছাড়ও দিতে হয়। ভূমিপুত্রদের দেবতা (শিব) ও শিব পক্ষের দেবীদেরকে সম্মানের সাথে স্থান করে দিতে হয় ব্রাহ্মণ্যধর্মে। যজ্ঞের বদলে তীর্থের ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। পাশাপাশি অবশ্য স্থানীয়দের কাছে অগ্রহণযোগ্য আর্য দেবতাদের স্থলে তৈরি করা হয় নতুন নতুন আর্যদেবতা। এর জন্য বৌদ্ধদের ‘অবতারবাদ’ তত্ত্ব গ্রহণ করা হয়।
এর মাধ্যমে তৈরি নতুন দেবতাদের মধ্যে রাম ও কৃষ্ণ অন্যতম। বলা হয় এরা বিষ্ণুর অবতার। এদিকে ভগবান বৌদ্ধকেও হিন্দুর অবতার হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া হয়। এভাবেই কথিত পৌরাণিক হিন্দুধর্মের সূত্রপাত করা হয়।
এরপর অনেকদিন গত হয়েছে। বিদেশি শাসকরা এসেছে এদেশে। এসেছে ইসলাম ও খ্রিস্টধর্ম। সবার সাথে হিন্দুকে করতে হয়েছে বোঝাপড়া। বিশেষ করে এ অঞ্চলের আদি বাসিন্দাদের বিশ্বাসের সাথেই শেষ পর্যন্ত করতে হয়েছে বোঝাপড়া। এ বোঝাপড়ায় বা বিবর্তন প্রক্রিয়ায় লোকায়ত সংস্কৃতি, দেব-দেবী, আচার-অনুষ্ঠান, পূজা-পার্বন, বিশ্বাস, সংস্কার ইত্যাদিই কাজ করছে প্রধান নিয়ামক শক্তি হিসেবে।
লক্ষণীয় বিবর্তন প্রক্রিয়ায় বেদ নির্বাসিত হয় নি। বস্তুত কোনও কিছুই বর্জিত হয়নি। বেদ, রামায়ণ, মহাভারত ও গীতা সবই অটুট রয়েছে। শুধু এদের সম্বন্ধে লোকের ধারণা ধীরে ধীরে পাল্টাচ্ছে। যেমন বেদ। বেদ এককালে প্রচলিত ছিল আর্যদের ধর্মগ্রন্থ হিসেবে। আজ বলা হচ্ছে এটি ভারতের প্রাচীনতম কাব্যগ্রন্থ যার মধ্যে বৈদিক সাহিত্যের পরিচয় পাওয়া যায়।
রামায়ণ ও মহাভারত গৃহীত হয়েছে মহাকাব্য হিসেবে, ধর্মগ্রন্থ হিসেবে নয়। তবে একথাও ঠিক অনেক হিন্দুর কাছে এসব গ্রন্থ আজও ধর্মগ্রন্থ, যদিও সিংহভাগ হিন্দু এ সম্বন্ধে আদৌ ভাবিত নয়। দৈনন্দিন পূজা-অর্চনা, আচার-অনুষ্ঠান, লোকসংস্কৃতি নিয়েই সিংহভাগ হিন্দু নিশ্চিন্ত।
দেখা যাচ্ছে একদিকে কিছু হিন্দু যখন বেদকে দেখছে ধর্মগ্রন্থ হিসেবে তখন বেশির ভাগ হিন্দু এর প্রতি উদাসীন। অন্যদিকে যারা বেদের প্রতি আকর্ষিত তাদেরকে দেখা যাচ্ছে প্রায় সব উপলক্ষেই বেদের আশ্রয় নিতে। এমন কি ইদানিং দেখা যাচ্ছে পাকিস্তানি ক্রিকেট টিমের বিরুদ্ধে ভারতীয় টিমের জয়লাভের আশায়ও বেদপাঠ হচ্ছে। সংঘটিত হচ্ছে যজ্ঞ।
ভারতীয় মিডিয়া এসব অনুষ্ঠান ফলাও করে প্রচার করছে। এমতাবস্থায় দেখা যাক বেদ কী, কী তাতে আছে, কিসে আকর্ষিত হচ্ছে শিক্ষিত হিন্দুর একটি অংশ, কেনই বা বেশির ভাগ হিন্দু বেদ সম্পর্কে উদাসীন। উল্লেখ্য নিচের বেদ পরিচিতির জন্য প্রধানত নির্ভর করা হয়েছে কলকাতার হরফ প্রকাশনীর প্রকাশিত চারটি বেদের বাংলা অনুবাদের ওপর।
১। বেদ এর রচনাকাল:
চারটি বেদের মধ্যে ঋগ্বেদই প্রাচীনতম। ড. সুকুমারী ভট্টাচার্যের মতে এই প্রাচীনতম বেদটির রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ থেকে ৯০০ অর্থাৎ ২৯০০ থেকে ৩২০০ বছর আগের ঘটনা। এদিকে দ্যা নিউ এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকার (ভলিউম-২০, পৃষ্ঠা ২৮৯) তথ্যে দেখা যাচ্ছে অধিকাংশ পণ্ডিত মনে করেন বেদ রচিত হয় ৩৫০০ বছর আগে। অনেকের মতে সিন্ধু সভ্যতার পতনের প্রেক্ষাপটে আর্য উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার পর বেদের রচনা শুরু এবং তা চলে কয়েক শতাব্দী ধরে।
২. বেদ এর রচয়িতা :
বেদের শ্লোকগুলো কে রচনা করেছেন এটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে এগুলো নানা মুনি-ঋষির রচনা হিসেবে প্রচলিত। বেদের সংকলন করেছেন কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস। অর্থাৎ ব্যাস বা ব্যাসদেব। তিনি কালো রঙের বলে কৃষ্ণ এবং দ্বীপে জন্ম গ্রহণ করেন বলে দ্বৈপায়ন এবং বেদ সংকলন করেন বলে বেদব্যাস বলে পরিচিত। পরবর্তী অধ্যায়ে মহাভারত আলোচনাকালে ব্যাসদেব কে, কীভাবে তার জন্ম ইত্যাদি বিষয় আলোচনা করা হয়েছে।
৩. ৪ টি বেদ:
বেদ সর্বমোট চারটি, যথা: ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ ও অথর্ববেদ এর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন বেদ হচ্ছে ঋগ্বেদ। ঋগ্বেদ ভারতের প্রাচীনতম সাহিত্যের নিদর্শন।
৪. বেদ এর ভাষা:
বেদের ভাষা প্রাচীন সেকেলে সংস্কৃত। শুধু সংস্কৃত বলেই নয়, ভাষা এতই সেকেলে বা দুর্বোধ্য যে পণ্ডিতদের ‘টীকা’ ছাড়া বেদের মর্মোদ্ধার করা কঠিন। টীকাগুলোর মধ্যে সায়নাচার্য্যের টীকাই বহুল প্রচলিত। ‘টীকা’ দরকার আরও একটি কারণে। বৈদিক যুগে একই শব্দের বিভিন্ন অর্থ হতো। উদাহরণস্বরূপ ‘গো’ শব্দের অর্থ হতো জল, রশ্মি, বাক্য, পৃথিবী ও গরু ইত্যাদি। একইভাবে অশ্ব = রশ্মি, ঘোড়া ইত্যাদি। জলের নাম ছিল একশো একটি।
একইভাবে পৃথিবী, রশ্মি, দিক, রাত্রি, ঊষা, দিন, মেঘ, বাক, নদী, কর্ম, মনুষ্য, অন্ন, বল ও যজ্ঞের বহু নাম ছিল। এসব শব্দের বর্তমান অর্থ সে যুগের অর্থের সাথে অনেক ক্ষেত্রেই বেমানান। এমতাবস্থায় টীকাই ভরসা। কিন্তু মুষ্কিল হচ্ছে টীকায় অবধারিতভাবে টীকাকারের নিজস্ব মত থাকে। ফলে প্রকৃত অর্থ অনেক সময় চাপা পড়ে যায় ।
৫. বৈদিক সাহিত্যের প্রথম গ্রন্থ:
ঋগ্বেদ হচ্ছে বৈদিক সাহিত্যের প্রথম গ্রন্থ। অর্থাৎ ভারতের প্রাচীনতম সাহিত্য। এতে তখনকার মানুষ, বিশেষত আর্যদের সমাজ ও ধর্মভাবনার একটি পরিচয় পাওয়া যায়।
৬. বেদ এর স্তোত্রগুলোর কেন্দ্রবিন্দু :
বেদের স্তোত্রগুলোর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে দেবতা ও যজ্ঞ। অর্থাৎ দেবতাদের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যে স্তোত্র রচিত হতো তা নিয়েই বেদের জন্ম।
৭. বৈদিক যুগের উপাসনা রীতি:
বৈদিক যুগে ঋষিরা যেখানেই শক্তি বা সৌন্দর্য্যের আভাস পেয়েছেন তার ওপরই দেবত্ব আরোপ করেছেন এবং তার জন্য স্তোত্র রচনা করেছেন। স্তোত্রের নামই ‘সৃক্ত’। দেবতাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন ‘অগ্নি’। তিনি পুরোহিতও বটে, কারণ অগ্নিতেই অন্য দেবতাদের উদ্দেশ্যে আহুতি দেওয়া হতো। অন্য দেবতারা হচ্ছেন বায়ু, জল, সূর্য, ঊষা, পৃথিবী, আকাশ প্রভৃতি।
৮. বেদ এর সাহিত্য:
মন্ত্র, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ নিয়ে বৈদিক সাহিত্য। একে দুটো ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে, যথা: জ্ঞানকাণ্ড ও কর্মকাণ্ড। কর্মকাণ্ড মানেই যজ্ঞসম্পর্কিত বিষয়াবলী। এতে পড়ে মন্ত্র ও ব্রাহ্মণ। উপনিষদ হচ্ছে জ্ঞানকাণ্ড । আরণ্যকে কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড উভয়েই আছে।
৯. বেদ এর কাঠামো:
প্রত্যেকটি বেদ কয়েকটি ‘মণ্ডলে’ (অধ্যায়) বিভক্ত। মণ্ডলের অধীনে আছে বেশ কিছু ‘সৃক্ত’। প্রত্যেকটি সূক্তে আছে বেশ কিছু ঋক।
১০. বেদ এ মোট মন্ত্র (ঋকের) সংখ্যা:
চারটি বেদে সর্বমোট ২০,৩৭৯টি ঋক আছে।
নিচে বেদের নাম ও ঋক সংখ্যা দেওয়া হল:
ঋগ্বেদ : ১০,৫৫২ টি শ্লোক যজুর্বেদ : ১,৯৭৫ টি শ্লোক সামবেদ : ১,৮৭৫ টি শ্লোক অথর্ববেদ : ৫,৯৭৭ টি শ্লোক
এখানে উল্লেখ্য, ঋগ্বেদের কিছু মন্ত্র (ঋক) যজুর্বেদ ও অথর্ববেদে আছে। আবার সামবেদের প্রায় মন্ত্রই (ঋক) ঋগ্বেদ থেকে নেওয়া। বলা বাহুল্য সকল বেদেরই একাধিক শাখা ছিল যা আজ বিলুপ্ত।
১১. বেদ এর সার সংকলন:
সামবেদই বেদের সারসংকলন। এটি গীত প্রধান ।
১২. যজ্ঞের অর্থ ও যজ্ঞানুষ্ঠান :
দেবতার উদ্দেশ্যে দ্রব্য ত্যাগই যজ্ঞ। যজ্ঞে যে সমস্ত দ্রব্যসামগ্রী লাগে সেগুলো হচ্ছে: কাঠ, আহুতির জন্য ঘি ও সোমরস। যিনি এ সমস্ত দ্রব্য ত্যাগ করেন অথবা যার কল্যাণে যজ্ঞ করা হয় তিনি হচ্ছেন যজমান। যারা যজ্ঞ করতেন তাঁরা হচ্ছে ঋত্বিক।
১৩. বেদবিদ্যার প্রকার ভেদ:
বেদবিদ্যা দুই প্রকার যথা: পরাবিদ্যা ও অপরাবিদ্যা। পরাবিদ্যা ও অপরাবিদ্যা কি?
পরাবিদ্যা:
যে বিদ্যার চেয়ে শ্রেষ্ঠবিদ্যা আর কিছুই নেই, যে বিদ্যার সন্ধান পেলে আর কিছুই জানার বাকি থাকে না বলে দাবি করা হয় তাই পরাবিদ্যা। পরাবিদ্যা হচ্ছে বিশ্বজ্ঞান। বিশ্বজ্ঞান স্বেচ্ছায় জাত হয়েছেন। ইনি স্বেচ্ছায় কর্ম করেন। তিনি আত্মজন্মা ও আত্মকর্মা। যিনি অদৃশ্য, অগ্রাহ্য (যাকে কর্ম-ইন্দ্রিয় দ্বারা গ্রহণ করা যায় না), যার মূল জানা নেই, যিনি নিরাকার (অরূপ), যিনি অচক্ষু (সবদেখেও চক্ষুহীন), যিনি অশোত্র (শুনেও কর্ণহীন), যিনি নিত্য, সর্বগত ও অব্যয় তিনিই ব্রহ্ম।
পরাবিদ্যা দ্বারা ব্রহ্মকে জানা যায়। বেদের অঙ্গীভূত কিছু রচনা অর্থাৎ উপনিষদ হচ্ছে পরাবিদ্যা। বেদের প্রান্তে অবস্থিত বলে একে উপনিষদ বলা হয়। এটিই পরবর্তীকালে বেদান্ত হিসেবে রচিত হয়। বেদান্ত শংকরাচার্য কর্তৃক প্রবর্তিত। এটি এখন তান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান রামকৃষ্ণ মিশনের প্রচারের বিষয়।
অপরাবিদ্যা:
যে বিদ্যার ব্যবহারিক উপযোগিতা আছে, যা ইহলৌকিক সুখের সন্ধান দেয় এবং পারলৌকিক মুক্তির উপায় বাতলে দেয় সেই বিদ্যা অপরাবিদ্যা। ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ, শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ ও জ্যোতিষ এগুলো অপরাবিদ্যা। মোট এই ১০টি অপরাবিদ্যার মধ্যে চারটি বেদ বাদে বাকি ছ’টি বেদাঙ্গ বলেও পরিচিত। অর্থাৎ অপরাবিদ্যা দুইভাগে বিভক্ত যথা: বেদ ও বেদাঙ্গ।
১৪. বেদের বিভাগ:
প্রতিটি বেদ মন্ত্র ও ব্রাহ্মণ নিয়ে গঠিত। ব্রাহ্মণের দুইভাগ, যথা: আরণ্যক ও উপনিষদ।
ঋগ্বেদ
আগেই বলা হয়েছে বেদের মধ্যে ঋগ্বেদ প্রাচীনতম। এতে ধর্মের কথার চেয়ে অন্যান্য প্রসঙ্গই বেশি। বস্তুত ৯০ শতাংশ সৃক্ত বা শ্লোকেই বিভিন্ন দেবতার বর্ণনা ও প্রশস্তি লিপিবদ্ধ আছে। এতে অবশ্য কিছু দর্শনমূলক শ্লোক আছে। বাকি শ্লোক বিবিধ বিষয়ের ওপর রচিত। নিচে ঋগ্বেদের একটি সাধারণ পরিচয় তুলে ধরা হল:
১. ঋগ্বেদের কাঠামো:
এই বেদে ১,০২৮ টি সূক্তের অধীনে সর্বমোট ১০,৫৫২টি ঋক আছে।
ঋকগুলোর রচনাকাজ শুরু হয় আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব দশম শতাব্দীতে এবং তা চলে কয়েক শতাব্দী যাবত। অনুমান করা হয় সিন্ধু সভ্যতা পতনের পর বেদের ঋকগুলোর রচনাকাজ শুরু হয়।
৩. ঋগ্বেদের ধর্ম :
ঋগ্বেদের ধর্ম ছিল এক কথায় সূর্যোপাসনা। বৈদিক আর্যরা যে ধর্ম নিয়ে ভারতবর্ষে আসে তাতে সূর্যের স্তুতি আছে।
৪. বেদের গঠনবিন্যাস :
গঠনবিন্যাস অনুযায়ী ড. মারী ভট্টাচার্য ঋগ্বেদকে তিনটি অংশে ভাগ করেছেন। এই তিনটি অংশ হচ্ছে নিম্নরূপ:
ক. দেবতার রূপবর্ণনা :
এর দুটো ভাগ। প্রথম ভাগে পড়ে দেবতার আকৃতি, বেশবাস, অলংকার, অস্ত্রশস্ত্র, রথ ও বাহনের বর্ণনা। দ্বিতীয় ভাগে পড়ে দেবতার শৌর্য, কীর্তি, পূর্বপ্রার্থীদের প্রতি অনুগ্রহের উল্লেখ।
খ. আপ্যায়ন :
এগুলো দেবতাকে কী নৈবেদ্য দিয়ে তুষ্ট করা হচ্ছে তার বিবরণ অর্থাৎ ভোজ্য, পানীয় ও স্তোত্রের বিবরণ। নতুন স্তব রচনার প্রতিশ্রুতি ও প্রাচীন স্তবগানের উল্লেখ ।
গ. প্রার্থনা :
ঋগ্বেদে প্রার্থিত বস্তু এক। দেবতাদের কাছে চাওয়া হচ্ছে বিজয়। আরও চাওয়া হচ্ছে শত্রুবিনাশ, পশুধন, স্বর্ণ, স্বাস্থ্য, শস্য, সস্তান, রোগমুক্তি ও পরমায়ু ।
ঋগ্বেদের সৃক্তগুর শ্রেণি:
বিষয়কে ভিত্তি করে ঋগ্বেদের সৃক্তগুলোকে মোটামুটি নিম্নলিখিত তিনটি শ্রেণিতেও ভাগ করা যায়। যথা:
প্রথম শ্রেণি :
বিশেষ দেবতা বা একাধিক দেবতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন ও প্রার্থনা জ্ঞাপন। দার্শনিক বিষয়।
দ্বিতীয় শ্রেণি :
দার্শনিক বিষয়।
তৃতীয় শ্রেণি :
মিশ্র জাতীয় (সুক্তগুলোর বিষয়বস্তু দেবতাও নয়, দর্শনও নয়)।
৫. ঋগ্বেদের সৃক্তগুলোর বিষয়বস্তু:
বিষয়বস্তু অনুযায়ী ঋগ্বেদের শ্রেণি বিভাগটি ওপরে দেখানো হয়েছে। হাজার হাজার শ্লোকের উদ্ধৃতি এখানে দেওয়া সম্ভব নয় বলে নিচে কিছু কিছু ঋকের উদাহরণ দিয়ে ঋগ্বেদের মূল বিষয়বস্তু সম্বন্ধে একটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হল :
ক. দেবতার উদ্দেশ্যেরচিত সূক্ত:
ঋগ্বেদে এ ধরনের সূক্তের সংখ্যা যে ৯০ শতাংশেরও বেশি তা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। এসব সূক্ত পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় ইন্দ্র ও অগ্নিই বৈদিক দেবতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ছিলেন। ইন্দ্রের ওপর আছে ২৫০ এর বেশি স্তব। তারপর অগ্নির স্থান। তাঁর উদ্দেশ্যে রচিত স্তবের সংখ্যা ২০০টি। তারপর সোম ও অন্যান্য দেবতার স্থান। দেবতাদের উদ্দেশে রচিত সৃক্ত বা স্তবগুলোতে দেবতাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়েছে। তাদেরকে দেওয়া হচ্ছে নৈবেদ্য। তারপর তাদের কাছে প্রার্থনা করা হচ্ছে নানা বস্তু।
ঋষিরা দেবতাদের কাছে ধন কামনা করছেন, গরু কামনা করছেন। শত্রুকে হত্যা করা, ধ্বংস করা ও তাদের ধনসম্পত্তি ঋষিদেরকে দেওয়ার জন্য দেবতাদের প্রতি আকুল আবেদন জানানো হয়েছে। স্বর্ণ, স্বাস্থ্য, শস্য, সন্তান, পরমায়ু ও রোগমুক্তি ইত্যাদি চাওয়া হয়েছে। দেবতাদের কাছে।
ঋকগুলো পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় ঋগ্বেদের ঋষিরা অত্যন্ত বৈষয়িক ছিলেন। আজকের দিনের হিন্দুর মতো সংসার ত্যাগী ভাব, বৈরাগ্যভাব, টাকা মাটি, মাটি টাকা’ ইত্যাদি ভাব ঋগ্বেদের ঋষিদের ছিল না। প্রতিপক্ষ বা শত্রুকে অর্থাৎ প্রাগার্য জনগোষ্ঠীকে ঘায়েল ও ধ্বংস করার কামনা তো পাতায় পাতায়।
খ. দার্শনিক তত্ত্বমুলক সুক্ত:
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে দার্শনিক তত্ত্বমূলক সৃক্তগুলো স্থান পেয়েছে ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে। অবশিষ্ট অন্যান্য ৯টি মণ্ডলেও কিছু কিছু দার্শনিক তত্ত্ব আছে। যেমন প্রথম মণ্ডলের ১৬৪ সংখ্যক সূক্ত। এই সূক্তেই বিখ্যাত বাণীটি পাওয়া যায়: ‘একং সদ্ধিপ্রা বহুধা বদন্তি।’ এদিকে অষ্টম মণ্ডলের ৫৮ নং সূক্তে পাই: ‘একং বা ইদং বিবর্ভূর সর্বম’।
এবারে আসা যাক দশম মণ্ডলের ১২৯ নং সূক্তে যা নাসদীয় সৃক্ত নামে খ্যাত। এখানে প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে সৃষ্টি কোথা হতে এল। বলা হয়েছে সৃষ্টির পূর্বে যা আছে তাও ছিল না, যা নেই, তাও ছিল না। তারপর তপস্যার প্রভাবে একটি সত্তার আবির্ভাব হল। তিনি বুদ্ধিযুক্ত। তার মধ্যে কামনা উদ্ভব হল। সেই কামনা হতেই সৃষ্টি উদ্ভূত হল। অর্থাৎ একটি বুদ্ধি শক্তি মণ্ডিত ইচ্ছাশক্তি বিশ্বসৃষ্টির মূলে।
১০ম মণ্ডলের ১২১ নং সূক্তের দেবতা প্রজাপতি। এতে প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে কোন দেবতাকে হবিদ্বারা পূজা করতে হবে। উত্তর দেওয়া হয়েছে যাকে হবিদ্বারা প্রীত করতে হবে তিনি হলেন প্রজাপতি। কারণ তিনি জাতমাত্রই সর্বভূতের অদ্বিতীয় অধীশ্বর হন, তার আজ্ঞা অন্য দেবতারা পালন করে, সসাগরা ধরা তারই সৃষ্টি, তিনি ব্যতীত আর কেউই সকল বস্তুকে আয়ত্ত রাখতে পারে নি। এখানে একেশ্বরবাদের বীজ পাওয়া যায় বলে কেউ কেউ মনে করেন।
১০ম মণ্ডলের ১২৫ নং সূক্তের দেবতা বাক্। আত্মাকেও এর দেবতা বলা হয়েছে। এই দেবতা নিজের বিষয় নিজেই বলেছেন। তিনি বলেছেন তিনি বিস্তর প্রাণীর মধ্যে আবিষ্ট আছেন ; তিনি দ্যুলোকে ও ভূলোকে আবিষ্ট আছেন; তিনি সকল ভুবনে বিস্তারিত হন। এখানে সর্বেশ্বরবাদের বীজ পাওয়া যায় বলে কেউ কেউ মনে করেন যা পরবর্তীকালে উপনিষদে ব্রহ্মবাদে পরিণতি লাভ করে।
১০ম মণ্ডলের ৯০ নং সূক্তে এক বিরাট পুরুষের কল্পনা করা হয়েছে। তাঁর সহস্র মাথা এবং সহস্র চরণ। পৃথিবীকে ব্যাপ্ত করেও তিনি তাকে অতিক্রম করেন; এত বিরাট তিনি। তাঁরই দেহ খণ্ডিত হয়ে বিভিন্ন বস্ত্র ও প্রাণির রূপ নিল। তাঁর মুখ হতে ব্রাহ্মণ হল, বাহু হতে রাজন্য হল, উরু হতে বৈশ্য হল, চরণ হতে শূদ্র হল। তাঁর মন হতে চন্দ্র হল, চক্ষু হতে সূর্য হল, মুখ হতে ইন্দ্র ও অগ্নি, প্রাণ হতে বায়ু হল।
তাঁর নাভি হতে আকাশ হল, মস্তক হতে স্বৰ্গ, চরণ হতে ভূমি, কর্ণ হতে দিক ও ভবন সকল সৃষ্টি হল। অর্থাৎ সংক্ষেপে বলা যায় তাঁর দেহই খণ্ডিত হয়ে বিশ্বের নানা বস্তু ও জীবে পরিণত হল। এখানে যা বীজ আকারে আছে তাই উপনিষদের ব্রহ্মবাদে পরিণত রূপ পায় বলে কেউ কেউ মনে করেন।
গ. মিশ্র জাতীয় সৃক্ত :
এই শ্রেণির সৃক্তের বিষয়বস্তু দেবতাও নয়, দার্শনিক চিন্তাও নয়। প্রতি সূক্তেই দেবতার উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে একাধিক দেবতার বিষয় উল্লেখ আছে সেখানে তাদের সকলেরই নাম উল্লিখিত হয়েছে। যেখানে বহু দেবতার বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে বিশ্বদেবতাগণকে দেবতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সকল ক্ষেত্রেই দেবতার অর্থ দেবতা নয়। অনেক ক্ষেত্রে দেবতাকে বিষয়বস্তুর সমার্থবোধক শব্দ হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ১ম মণ্ডলের ১৬২ নং সূক্তে অশ্বমেধ যজ্ঞের বর্ণনা দেওয়া আছে।
এর দেবতা হিসাবে অশ্বের উল্লেখ করা হয়েছে। একই মণ্ডলের ১৭৯ নং সূক্তে লোপামুদ্রা এবং অগস্ত্যর মধ্যে রতির বিষয়ে কথোপকথন আছে। এখানে রতি দেবতা বলে উল্লিখিত হয়েছে। ১০ নং মণ্ডলের ৯৫ নং সূক্তে উর্বশী ও পুরুরবার কথোপকথন আছে। এখানে উর্বশী ও পুরুরবা দেবতা বলে উলিখিত হয়েছে। ১০ম মণ্ডলের ১৪৫ নং সূক্তে একটি ভেষজের উল্লেখ আছে যা সপত্নীকে পরাজিত করতে সাহায্য করে। এখানে সপত্নীবাধনই দেবতা। ১০ম মণ্ডলের ১৭৩ নং সূক্তে রাজার বিষয়ে আলোচনা আছে ৷
এখানে রাজাই দেবতা বলে উল্লিখিত হয়েছে। ৭ নং মণ্ডলের ১০৩ নং সূক্তে ব্যাঙেদের উল বর্ণনা আছে। এর সঙ্গে ধর্মের কোনোও সম্পর্ক নেই, নিতান্তই প্রাকৃতিক ঘটনার বর্ণনা। ১০ম মণ্ডলের ১৮নং সূক্তে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার বর্ণনা আছে। ১০ম মণ্ডলের ৮৫ নং সূক্তে বিবাহের বিষয়ের বর্ণনা আছে। এদিকে ১০১৭ নং সূক্তে দানের সুখ্যাতি করা হয়েছে এবং ১৪৬ নং সূক্তে বনানীর বর্ণনা আছে। এগুলির সঙ্গে ধর্মের কোনো সংযোগ নেই।
ঋগ্বেদে জাদুবিশ্বাসের ভিত্তিতে রচিত অল্পসংখ্যক মন্ত্র পাওয়া যায়। কোথাও পাখীর ডাক মঙ্গল বিধান করে, কোথাও কোন রোগ কোন রাক্ষস কর্তৃক সৃষ্ট হয়েছে এই ধরনের বিশ্বাসকে ভিত্তি করে মন্ত্র রচিত হয়েছে। এগুলোকে জাদুবিদ্যা সম্পর্কিত সৃক্ত বলা যায়। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ১ম মণ্ডলের ১৯১ নং সূক্তে নানা জীবজন্তুর বিষক্রিয়া নষ্ট করবার উপায় চিন্তা করা হয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মধুবিদ্যা আয়ত্ত করলে এই বিষ নাশ করা যায়। এই মধুবিদ্যাই জাদুবিদ্যা বলে বিশ্বাস করা হয়।
২য় মণ্ডলের ৪২ ও ৪৩ সূক্তে শকুনির ডাক যে মঙ্গল বিধান করে এই ধরনের একটি বিশ্বাস লক্ষিত হয়। তাই শকুনির সান্নিধ্য কামনা করা হয়েছে এবং তাকে ডাকতে বলা হয়েছে। এখানে শকুনির ডাকের জাদুশক্তির ইঙ্গিত আছে।
১০ম মণ্ডলের ১৬২ নং সূক্তে বিশ্বাস করা হয়েছে যে গর্ভনাশের কারণ হল একটি বিশেষ রাক্ষস। এই সূক্তটিতে সে রাক্ষসকে বিদূরিত করার জন্য মন্ত্র পাওয়া যায়। এও জাদুবিদ্যা প্রয়োগের একটি উদাহরণ।
১০ম মণ্ডলের ১৬৩ নং সূক্তটি দুইভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত দেখা যায় তখনকার দিনে মানুষ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হতো। কারণ এই সূক্তটিতে যক্ষ্মারোগ নাশের মন্ত্র আছে। দ্বিতীয়ত তাতে মন্ত্র উচ্চারণ করে রোগ দূর করবার একটি দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। এও জাদুবিদ্যার নিদর্শন।
৬. ঋগ্বেদের দেবতা:
ঋগ্বেদের দেবতার সংখ্যা নিয়ে মতানৈক্য দেখা যায়। ব্যাপক অর্থে দেবতা শব্দের ব্যবহার অর্থাৎ প্রস্তর খণ্ড, ধনুক, মুণ্ডক ইত্যাদিকে দেবতা হিসেবে আখ্যায়িত করার কারণেই এই মতানৈক্য। ঋগ্বেদ সংহিতার একাধিক স্থানে দেবতাদের সংখ্যা সম্বন্ধে উক্তি আছে। দুটি ঋকে তাঁদের সংখ্যা ৩৩৩৯ জন বলে উল্লেখিত হয়েছে।
কিন্তু ঋগ্বেদের সৃক্তগুলিতে যাদের দেবতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে তাঁদের সকলকে ধরলেও এত দেবতা পাওয়া যায় না। এদিকে ঋগ্বেদের আর এক জায়গায়। ৩৩ জন দেবতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর ভিত্তিতেই বোধ হয় ‘শতপথ ব্রাহ্মণে’ ৩৩টি দেবতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সম্ভবত এই ৩৩ কেই হিন্দুরা ৩৩ কোটিতে উন্নীত করেছে।
সবকিছু বিচার করে মনে হয় ঋগ্বেদের প্রকৃত দেবতা হচ্ছে পৃথিবী বা অন্তরীক্ষ বা দ্যুলোকের এমন সব প্রাকৃতিক বিষয় যাদের মধ্যে শক্তির প্রকাশ দেখে ঋষিরা তাঁদের ওপর দেবত্ব আরোপ করেছেন। ঋগ্বেদের সূক্তগুলো প্রধানত আর্ত মনোভাব নিয়ে রচিত।
শত্রু বা রোগ বা বিপদ হতে পরিত্রাণ বা বৈষয়িক সমৃদ্ধি কামনা করেই এই শ্রেণির সৃক্তগুলি রচিত। কাজেই যেখানে শক্তির প্রকাশ তার কাছেই প্রার্থনা নিবেদিত হয়েছে। অবশ্য অতিরিক্তভাবে তাদের মহিমাও কীর্তিত হয়েছে। এদের উপর ব্যক্তিত্ব আরোপ করে দেবতা বলে কল্পিত হয়েছে। এভাবেই ঋগ্বেদের দেবতা সৃষ্টি হয়েছে। কাজেই এই লক্ষণগুলো দিয়েই ঋগ্বেদের প্রকৃত দেবতাদের নির্বাচন করা দরকার বলে সবাই মনে করেন।
ওপরের নীতির ভিত্তিতে ঋগ্বেদের সূক্তে বর্ণিত নিম্নোক্ত দেবতাদেরকে প্রকৃত দেবতা বলে স্বীকৃতি দেওয়া যায়:
বেদের দেবতা :
অগ্নি
মরুৎগণ
আদিত্যগণ
রাত্রি
সবিতা
অশ্বিদ্বয়
সোম
অর্জমা
অপগণ
মিত্র
বৃহস্পতি
ব্ৰহ্মণস্পতি রুদ্র
অদিতি
ভগ
বিষ্ণু
পজন্য
বরুণ
দ্যৌ
ঊষা
পৃথিবী
সরস্বতী (নদী)
উল্লেখ্য বেদের উপরোক্ত দেবতাদের মধ্যে আজ আর কেউ জনপ্রিয় নয়। কেবলমাত্র বিষ্ণু অবতার তত্ত্বের মাধ্যমে রাম ও কৃষ্ণ রূপে টিকে আছেন। আর যদি রুদ্র দেবতাকে শিব হিসেবে ধরা হয় তাহলে তিনি টিকে আছেন মহাদাপটে।
৭. ঋগ্বেদের কালে সমাজ/ধর্ম/অর্থনীতি ইত্যাদি :
ঋগ্বেদের বিভিন্ন সূক্তে ওই সময়ের সমাজ, ধর্ম ও অর্থনীতি সম্বন্ধে একটা ধারণা পাওয়া যায়। নিচে এর একটা সার সংক্ষেপ দেয়া হল:
ক. আয়ু : ওই সময়ে ঋষিদের পরমায়ু কম-বেশি একশো বছরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। খ. ধনবণ্টন : অন্তত একটি ঋকে ধনবণ্টনে সমতার প্রতি আকুতি লক্ষ করা যায়। গ. জাতিভেদ : ওই সময়ে জাতিভেদ প্রথা ছিল না। তখন জাতি বলতে দুটো শ্রেণিকে বুঝাত-আর্য ও অন-আর্য (দস্যু)। ‘ক্ষত্রিয়’ অর্থে বলবানকে বুঝাত। আর্যরা অন আর্যদের সমীহ করে চলত। ঘ. গো-ধন : বৈদিক যুগের মানুষের কাছে গোধন ছিল গুরুত্বপূর্ণ ধনসম্পদ। সকলেই দুগ্ধবতী গাভীর জন্য প্রার্থনা করত। সবাই গোধন রক্ষায় ব্যস্ত থাকত। ঙ. ব্যবসা : আর্যদের কেউ কেউ গো ও মেষপালন ব্যবসায় নিয়োজিত ছিল।
চ. সমুদ্রযাত্রা : সমুদ্র যাত্রা নিষিদ্ধ ছিল না, বরং তার প্রশংসা। ছ. কৃষিকাজ : আর্যরা কৃষি কাজে নিযুক্ত ছিল। জ. পাশা খেলা : এই খেলাটি সমাজে বহুল প্রচলিত ছিল। এর নেশায় আর্যরা সর্বস্ব হারাত। এমনকি স্ত্রী পর্যন্ত হারাত। ঝ. দত্তক পুত্ৰ : দত্তক পুত্র গ্রহণের প্রথা প্রচলিত ছিল। ঞ. যক্ষ্মারোগ : ঝগ্বেদে যক্ষ্মারোগের উল্লেখ আছে।
ট. মাংস : খাদ্য হিসেবে আর্যদের মধ্যে তখন গো, মহিষ এবং অশ্বের মাংস জনপ্রিয় ছিল। ঠ. স্ত্রীজাতি : স্ত্রীজাতির সম্মান ছিল। স্ত্রীলোক পুরুষের সঙ্গে একত্রে বসে যজ্ঞে অংশগ্রহণ করত। ড. বহুবিবাহ : সমাজে বহু বিবাহ প্রচলিত ছিল । ঢ. একেশ্বর চিন্তা আর্যরা প্রত্যেকটি বিস্ময়কর ঘটনা ও কার্যে একটি করে দেবতা কল্পনা করে নিয়েছিল। পরে তারা উপলব্ধি করেন সবকিছুর মূলে একই শক্তি বিদ্যমান। তখন তারা বললেন এক ছাড়া দ্বিতীয় নেই।
যজুর্বেদ
১. যজুর্বেদ পরিচিতি :
এই বেদটি দু’ভাগে বিভক্ত, যথা: শুক্ল ও কৃষ্ণ যজুর্বেদ। কৃষ্ণ অংশের আরেক নাম তৈত্তরীয় সংহিতা’। এ নামের পেছনে মজার একটি ঘটনা আছে। ঘটনাটি এইরূপ গুরু বৈশম্পায়ণ ও শিষ্য যাজ্ঞবল্ক্য। বৈশম্পায়ণ ব্রহ্ম হত্যার অপরাধে পাপী। তিনি প্রায়শ্চিত্তের জন্য শিষ্যদেরকে কৃচ্ছ্রসাধনের জন্য নির্দেশ দেন। তখন যাজ্ঞবল্ক্য একাই কৃচ্ছ সাধন করতে চাইলেন।
বৈশম্পায়ন একে অসহ্য অহমিকা মনে করে ক্রুদ্ধ হন এবং যাজ্ঞবল্ক্যকে অধীত বেদ প্রত্যর্পণ করতে বলেন। আদেশ মোতাবেক যাজ্ঞবল্ক্য অধীত বেদ বমন করেন। তখন বৈশম্পায়ণের অন্যান্য শিষ্যরা তিত্তির পক্ষীর রূপ ধারণ করে তা গ্রহণ করেন। এজন্য এই বেদ তৈত্তরীয়’ বা কৃষ্ণ যজুর্বেদ বলে খ্যাত হয়।
এদিকে যাজ্ঞবল্ক্য নির্মল বেদবিদ্যা লাভের জন্য সূর্যদেবের আরাধনা করেন। তখন সূর্যদেব বাজী রূপ (বাজসনি যাজ্ঞবন্ধ্যের পিতার নাম) ধারণ করে যাজ্ঞবল্ক্যকে বেদবিদ্যা প্রদান করেন। এই বেদ শুক্ল যজুর্বেদ বা বাজসনেয়িসংহিতা নামে পরিচিত হয়।
২. যজুর্বেদের ভাষা:
যজুর্বেদের মন্ত্রগুলোর অধিকাংশই গদ্যে রচিত।
৩. যাজ্ঞবল্ক্য :
তিনি বিশ্বামিত্রের বংশধর। যাজ্ঞবন্ধ্যের পিতা নানা নামে পরিচিত, যথা: চারায়ণ, দেবরাত, ব্রহ্মরাত, যজ্ঞবল্ক, বাজসনি ইত্যাদি। তাঁকে বৈদিক যুগের শেষার্ধের যুগমানব হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি ইহ জগতকে মায়া বলে উড়িয়ে দেননি।
৪. শুক্ল ও কৃষ্ণ যজুর্বেদের আসল মর্মার্থ :
কাহিনীতে বর্ণিত ঘটনা যাই হোক না কেন গবেষকরা বলছেন প্রকৃতপক্ষে শুক্ল যজুর্বেদ শুদ্ধ মন্ত্রমাত্রের সংকলন। আর কৃষ্ণ যজুর্বেদে মন্ত্রের সঙ্গে অঙ্কুর-রূপে ‘ব্রাহ্মণ’ সাহিত্যধর্মী প্রচুর গদ্যনির্দেশের মিশ্রণ আছে। তাই একে কৃষ্ণ যজুর্বেদ বলা হয়।
৫. শুক্ল যজুর্বেদের ভেতরে আছে দুটো বিশিষ্ট রচনা:
শুক্ল যজুর্বেদ সংহিতার শেষাংশে রয়েছে ‘শতপথ ব্রাহ্মণ’ এবং তারও শেষাংশে আছে ‘বৃহদারণ্যকোপনিষদ’। এর সবটার রচয়িতা যাজ্ঞবল্ক্য। উল্লেখ্য ‘ব্রাহ্মণ’ সাহিত্যের মধ্যে বিশিষ্ট স্থান হচ্ছে ‘শতপথ’ ব্রাহ্মণের। আবার আরণ্যক ও উপনিষদের মধ্যে ‘বৃহদারণ্যকোপনিষদ’ একটি তাৎপর্যপূর্ণ রচনা।
৬. শতপথ ব্রাহ্মণে (শুক্ল যজুর্বেদে) আছে:
ধেনু বা অনডুহ (ষাড়) মাংস ভক্ষণ করলে পতিত হতে হয়। আবার আরেক জায়গায় যাজ্ঞবল্ক্যই বলছেন: আমি কিন্তু (গোমাংস) ভক্ষণ করব যদি সেটা সুসিদ্ধ সুস্বাদু) হয়। ‘বৃহদারণ্যকোপনিষদে’ও (শুক্ল যজুর্বেদ) বলদের বা বৃষভের মাংসযুক্ত অন্ন ভোজন করাবার উপদেশ আছে। ‘বৃহদারণ্য কোপনিষদে’ আত্মা সম্বন্ধে বলা হয়েছে ‘প্রাণ দ্বারা যে প্রাণিত হচ্ছে সেই তোমার আত্মা। সবকিছুরই সে অভ্যন্তরবর্তী। পুত্রের চেয়ে প্রিয় বিত্তের চেয়ে প্রিয়, অন্যসব কিছুরই অন্তরতর যা তাই আত্মা’।
৭. যাজ্ঞবন্ধ্যের অবদান:
যাজ্ঞবল্ক্য গুরুর বিদ্যা প্রত্যর্পণ করে দিয়েছেন। কিন্তু তিনি গোমাংস ভক্ষণে বাধানিষেধ মানতে চান নি, ক্ষত্রিয়কে ব্রহ্মবিদ্যার শ্রেষ্ঠ আচার্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন, নারীকে ব্রহ্মবিদ্যা দান করেছেন, ক্ষুধা ও মৃত্যুকে পরম শত্রু বলে অভিহিত করেছেন।
৮. আর্য ও প্রাগার্য জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণ:
যজুর্বেদের যুগেই আর্যজনগোষ্ঠী ও প্রাগার্য জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংমিশ্রণের স্পষ্ট আভাস পাওয়া যায়। এর অর্থ এই নয় যে ঋগ্বেদের আমলে সংমিশ্রণ ছিল না। বস্তুত দুই জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণ ঋগ্বেদের আমলেই শুরু হয়। এবং তা স্পষ্টরূপ ধারণ করে যজুর্বেদের আমলে।
সামবেদ
১. সামবেদের পরিচয়:
সামবেদ বিভিন্ন ঋষি কর্তৃক রচিত মন্ত্রের সংকলন। তাই একে ‘সামবেদ-সংহিতা’ বলা হয়। এটি একটি সঙ্গীত গ্রন্থ। বৈদিক যজ্ঞানুষ্ঠানে এই গানগুলো গাওয়া হতো। ‘সামবেদের’ ৭৫টি মন্ত্র বাদ দিলে বাকি সব মন্ত্র ঋগ্বেদ থেকে নেওয়া।
২. সার সংকলন:
সামবেদই বেদের সার সংকলন হিসেবে বিবেচিত। সামবেদের গান সূর্যকে ঘিরে হয়। ওম উচ্চারণ করে সামবেদের গান গাওয়া হয়। ‘সাম’ এর মধ্যস্থিত ‘সা’ এর অর্থ প্রকৃতি, অক্ষয়া ঐশীশক্তি এবং ‘অম’ এর অর্থ আত্মা। আত্মা সূর্যমগুলে আসীন। অর্থাৎ সূর্যরূপ জগতের আত্মার সঙ্গে যা ওতপ্রোতভাবে জড়িত তাই ‘সাম’। আবার যেহেতু ঋকমন্ত্রের দ্বারা সামগান করা হয় সেহেতু ঋকই ‘সাম’ এবং ‘সাম’ই সূর্য।
‘ওম’ হচ্ছে: ‘অ + উ + ম’ এই তিন অক্ষরের সমষ্টি। অ = পৃথিবী, উ = অন্ত রিক্ষ এবং ম = দ্যুলোক। ওম্ শব্দ দ্বারা পূর্ণ ব্রহ্মকে বোঝানো হয়। ‘ওম্’ দ্বারা তিনলোকের অতিরিক্ত যে জগৎ যা মানুষের বাক্য ও মনের অগোচর তাকেও বোঝায়। যেহেতু সূর্যের মধ্যে পরমাত্মার প্রকাশ তাই ওম্ দ্বারা জগতের আত্মা সূর্যের মধ্যে অধিষ্ঠানকেও বোঝায়।
৩. দুইভাগে বিভক্ত :
সামবেদ দুইভাগে বিভক্ত, যথা আর্চিক ও গান। যে গ্রন্থ কেবল সঙ্গীতের সংকলন তার নাম ‘আর্চিক’। যে গ্রন্থে সঙ্গীতের স্বরলিপি আছে তার নাম ‘গান’। আৰ্চিক সঙ্গীতের দুইভাগ যথা: পূর্বার্চিক ও উত্তরার্চিক ।
৪. মন্ত্র সাজানো পদ্ধতি:
পূর্বার্চিকের মন্ত্রগুলি দেবতা ও ছন্দ অনুসারে সাজানো হয়েছে। ফলে প্রথমেই পাওয়া যায় অগ্নিস্মৃতি, তারপর ইন্দ্র ও পরমাণ সোম স্তুতি।
আরণ্যক খণ্ডের পর আছে মহানাম্নী আৰ্চিক। এতে আছে ত্রিলোকের আত্মা ইন্দ্রের স্তুতি।
৫. সামের আশ্রয়:
সামের আশ্রয় ‘স্বর’, স্বরের আশ্রয় ‘প্রাণ’, প্রাণের আশ্রয় ‘অন্ন’, ‘অন্নের’ আশ্রয় ‘জল’, ‘জলের’ আশ্রয় পুনরায় ‘স্বর’ বা আদিত্য সূর্য।
অথর্ববেদ
১. অথর্ববেদের নাম ইতিহাস:
অথর্ববেদের নাম অথর্ব (অচল) কেন হল তার কোনো সঠিক ইতিহাস নেই। অথর্ববেদ ‘অথর্ব’ (অচল) তো নয়ই বরং এই বেদই একমাত্র বেদ যা সচল আছে। অথর্ববেদেই ‘অথর্বের’ অর্থ করা হয়েছে পরব্রহ্ম ভগবান।
২. অথববেদ পরবর্তী সংযোজন :
অনেকের মতে গোড়ায় ঋক, যজু ও সামবেদই ছিল যাকে বলা হতো ত্রয়ীবেদ। অথর্ববেদ পরবর্তী সময়ে সংযোজিত হয়েছে। তবে এই মত সকলে গ্রহণ করেন না।
৩. অথর্ববেদের সাথে অন্যান্য বেদের পার্থক্য :
অথর্ববেদই একমাত্র বেদ যা সকলের সব প্রয়োজন মেটানোর দিকে নজর দিয়েছে। ঋক, যজু ও সামবেদ প্রধানত মোক্ষপ্রাপ্তির দিকে দৃষ্টি দিয়েছে। বিপরীতে অথর্ববেদ ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ ইত্যাদি বিষয়ের কোনোটাকেই উপেক্ষা করে নি।
৪. বিষয়বস্তু :
অথর্ববেদে আছে আয়ুর্বেদ শাস্ত্র অর্থাৎ মানুষের রোগ নিবারণের ব্যবস্থা। শত্রুজয়, পাপক্ষয় ইত্যাদির জন্য এতে রয়েছে মন্ত্রাদি। আরও আছে সৌভাগ্যকরণ, পুত্রাদিলাভ, সুপ্রসব, কন্যাদির বিবাহ, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি নিবারণ, বাণিজ্যে শ্রীলাভ ইত্যাদি বিষয়ক মন্ত্র। বাস্তু সংস্কার, গৃহপ্রবেশ, চূড়াকরণ, উপনয়ন, জাতকর্ম ও বিবাহ ইত্যাদি বিষয়ও অথর্ববেদের বিষয়বস্তু। বেদগুলোর মধ্যে অথর্ববেদেই প্রথম ‘সহমরণ’ এর কথা পাওয়া যায়।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে অথর্ববেদে ইহলৌকিক বিষয়াদি আলোচিত হয়েছে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, এই বেদে পারলৌকিক বিষয়াদি উপেক্ষিত হয়েছে। দেবতা কি, দেবতার স্বরূপ কি, ভগবান কিভাবে সর্বব্যাপী, তাকে কিভাবে পাওয়া যেতে পারে ইত্যাদি বিষয়ও অথর্ববেদের বিষয়বস্তু।
৫. অথর্ববেদে রয়েছে আর্যঐক্যের দ্বারা অন-আর্য বিনাশের আহ্বান :
অথর্ববেদের ষষ্ঠ অধ্যায়ের সাত নম্বর পরিচ্ছেদের দুই নম্বর সূক্তে রয়েছে আর্য ঐক্যের এক বাণী। বলা হচ্ছে: “হে জনগণ, তোমাদের সংকল্প একরূপ হোক, তোমাদের হৃদয় এক হোক, তোমাদের মন সমান হোক। যাতে তোমাদের সকল কাজ একসাথে হয়, সেজন্য তোমাদের সংযুক্ত করছি। শত্রুর ক্রোধ বিনষ্ট হোক, আমাদের বিস্তৃত আয়ুধগুলি স্ব-স্ব কার্য-সমর্থ হোক, সেরূপ শত্রুর বাহুদ্বয় তাদের মনের সাথে থাকুক অর্থাৎ অস্ত্রচালনে অসমর্থ হোক।
হে শত্রুর পরাভবকারী ইন্দ্র, শত্রুদের শোষক বল আমাদের কাছে পরাঙ্মুখ করে বিনাশ কর এবং তাদের ধন আমাদের অভিমুখ কর…।” উল্লেখ্য এখানে শত্রু হচ্ছে অন-আর্য জনগোষ্ঠী।