‘বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরিয়ে আনার জন্য আমি দেশে এসেছি। আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।’
দেশকে আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরিয়ে আনেন শেখ হাসিনাঃ দীর্ঘ নির্বাসন শেষে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে তৎকালীন কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানানোর জন্য উপস্থিত প্রায় ১৫ লাখ মানুষের হৃদয় ছোঁয়া ভালোবাসার জবাবে শেখ হাসিনা এভাবেই তাঁর অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছিলেন।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আজকের জনসভায় লাখো লাখো চেনামুখ আমি দেখছি।শুধু নেই আমার প্রিয় পিতা বঙ্গবন্ধু, মা আর ভাইয়েরা এবং আরো অনেক প্রিয়জন। শেখ হাসিনা বলেন, ভাই রাসেল আর কোনো দিন ফিরে আসবে না, আপা বলে ডাকবে না। সব হারিয়ে আজ আপনারাই আমার আপনজন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হন। এ সময় তাঁর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা প্রবাসে থাকায় ঘাতকদের হাত থেকে রেহাই পান। ১৯৮১ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়।
একই বছরে ১৭ মে তিনি বাংলার মাটিতে ফিরে আসেন। এদিন বিকেল সাড়ে ৪টায় ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের ৭৩৭ বোয়িং বিমানে তিনি ভারতের রাজধানী দিল্লী থেকে কলকাতা হয়ে তৎকালীন ঢাকা কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান।
শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিয়ে পরদিন ১৯৮১ সালের ১৮ মে দৈনিক ‘সংবাদ’ ‘লাখো জনতা অকৃপণ প্রাণঢালা অভ্যর্থনার মধ্যদিয়ে বরণ করে নেয় তাদের নেত্রীকে’ শিরোনামে লিখে- রাজধানী ঢাকা গতকাল (১৭ মে) মিছিলের শহরে পরিণত হয়েছিল। প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টিও মিছিলের গতিরোধ করতে পারেনি। শ্লোগানেও ভাটা পড়েনি। লাখো কণ্ঠের শ্লোগান নগরীকে প্রকম্পিত করেছে।’
সংবাদ আরো লিখে, বিকেল সাড়ে চারটায় আকাশে যখন শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমানটি দেখা যায় তখন সকল নিয়ন্ত্রণ আর অনুরোধ আবেদন অগ্রাহ্য করে হাজার হাজার মানুষ বিমানবন্দরের ভেতরে ঢুকে যায়। অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই বিমানটি অবতরণ করে। জনতা একেবারেই বিমানের কাছে চলে যায়। বহু চেষ্টার পর জনতার স্রোতকে কিছুটা সরিয়ে ট্রাকটি ককপিটের দরজার একেবারে সামনে নেয়া হয়। এই সময়ে শেখ হাসিনা ভেতর থেকে জনতার উদ্দেশ্যে হাত নাড়েন।
বেলা ৪টা ৩২ মিনিটে শেখ হাসিনা কাঠের সিঁড়ি দিয়ে ট্রাকে নেমে আসেন। এই সময় লাখো জনতার কণ্ঠে ছিল গগন বিদারী শ্লোগান- ‘হাসিনা তোমায় কথা দিলাম- মুজিব হত্যার বদলা নেব।’ এ সময় অনেকের চোখে ছিল অশ্রুধারা। প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাক যখন মালা পরিয়ে দেন তাঁকে, তখন শেখ হাসিনাও অঝোর ধারায় কান্না করছিলেন।
রাস্তাঘাট স্বাভাবিক জীবন যখন ব্যাহত তখন এখানে অপেক্ষা করে কয়েক লাখ মানুষ। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় তিনি গণসংবর্ধনা মঞ্চে উপস্থিত হন। সেদিন তিনি বলেছিলেন, বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য তিনি দেশে এসেছেন।
শুধু তাঁর দল নয়, শেখ হাসিনার সেদিনের সেই বক্তব্যে নতুন করে উজ্জ্বেবিত হয়ে উঠে সারা দেশের মানুষ। দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত মেঘের মধ্যে যেন নতুন সূর্যের প্রকাশ ঘটে। হতাশ বাঙ্গালীর জীবনে এক সঞ্জীবনী আলো ছড়িয়ে পড়ে। সেদিন তিনি যে সুরের আগুন লাগিয়ে ছিলেন, সে আগুন যেন ছড়িয়ে পড়ে সব খানে।
টেকনাফ থেকে তেতুলিয়ায় আবার ধ্বণিত হয় মুক্তিযুদ্ধের সেই রণহুংকার ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’ বঙ্গোপসাগরের ঢেউয়ের গর্জনের মতো মুহুমুহু শ্লোগান ঢাকা কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে সীমাবদ্ধ থাকে না। সেই ঢেউ আরো প্রবল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে, অলিতে-গলিতে এমনকি গৃহিনীর রান্না ঘরেও। বীর বাঙ্গালী যেন আবার জেগে উঠে। স্বপ্ন দেখে আবার নতুন সূর্যের। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি যেন খুঁজে পায় নতুন অভিভাবকের।
সেদিনের পর এত বছর চলে গেলেও শেখ হাসিনা তাঁর প্রতিশ্রুতি রেখেছেন। অক্ষরে অক্ষরে তিনি কথা রেখে যাচ্ছেন। আর আমাদের পাশে থাকার জন্য আত্মত্যাগও তার কিন্তু কম নয়। এ কথা বললে মোটেও অতুক্তি হবে না, জীবনবাজি রেখেই তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি রেখে যাচ্ছেন।
তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে যে বাংলাদেশ অনেকটাই আবার পাকিস্তান হয়ে গিয়েছিল, সেই দেশকে আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরিয়ে আনা।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও ১৪ দলীয় জোটের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু বলেন, ‘আমরা যেমন বলি বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। তেমনই শেখ হাসিনার জন্ম না হলে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণের কাজ জাতি চোখে দেখতো না। শেখ হাসিনার জন্মের সফলতা ও স্বার্থকতা তাঁর কর্মের মধ্য দিয়ে।’
বাসস পরিচালনা বোর্ডের সভাপতি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, শেখ হাসিনা তাঁর সকল কর্মকান্ডে বঙ্গবন্ধুকে অনুসরণ করছেন। এই মুহূর্তে তিনি জাতিসংঘে বাংলাদেশের মানুষের কথা বলছেন।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনাও সেটা অনুসরণ করছেন। তাঁরই ধারাবাহিকতায় দেশে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং জনগণের উন্নয়নের ও নারীর ক্ষমতায়নসহ অন্যান্য সব ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা অনন্য ভূমিকা রেখে চলেছেন। বাংলাদেশের মাটিতে পা দিয়ে জনগণকে দেয়া সেই প্রতিশ্রুতি তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে যাচ্ছেন।
বঙ্গবন্ধু কন্যা ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে যখন আওয়ামী লীগের হাল ধরেন তখন থেকেই প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী তাঁকে হত্যা করতে সক্রিয় হয়ে উঠে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হত্যা অপচেষ্টাগুলো হচ্ছে-১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর স্বৈরাচার বিরোধী অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে সচিবালয়ের সামনে তাঁর গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। এ সময় আওয়ামী লীগ কর্মী নূর হোসেন মারা যান।
শেখ হাসিনাকে হামলার বড় চেষ্টা চালানো হয়, পরের বছর ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি। তিনি জনসভা করতে চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন। চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে মিছিল করে জনসভাস্থলে যাওয়ার পথে মিছিলে হামলা হয়। তাঁর গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। সেদিন প্রায় ১৪ জন নেতাকর্মী নিহত হন।
প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় ২০০০ সালের ২০ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় জনসভাস্থলের কাছে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রাখা হয়েছিল। এই বোমা গোয়েন্দাদের কাছে ধরা পড়ে। বোমাটি বিস্ফোরিত হলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত জনসভাস্থল।
সর্বশেষ ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে শান্তি সমাবেশস্থলে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এতে শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতা অল্পের জন্য এই ভয়াবহ হামলা থেকে বেঁচে গেলেও অপর ২৪ জন নিহত হন।
বেশকয়েক বছর আগে প্রভাবশালী মার্কিন গণমাধ্যম হাফিংটন পোস্টের অস্ট্রেলীয় সংস্করণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিশ্বের সবচেয়ে সুখী নারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের টাইগারদের ঐতিহাসিক টেস্ট বিজয়ের পর হাফিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়।
প্রতিবেদনটিতে সবচেয়ে বেশি প্রশংসা করা হয় প্রধানমন্ত্রীর ক্রীড়ানুরাগের। যে অনুরাগে সব ব্যস্ততা সামলেও লাল-সবুজের পতাকাবাহীদের উৎসাহ যোগাতে মাঠে ছুটে যান তিনি। সাফল্যে ক্রিকেটারদের কাছে ডেকে পরম স্নেহে পিঠ চাপড়ে দেন। অনুপ্রেরণা যোগান, সাফল্যের সিঁড়ি আরও ঊর্ধ্বমুখী করতে।
শেখ হাসিনা ২০১৬ সালে মার্কিন ফোর্বস ম্যাগাজিনের বিবেচনায় বিশ্বের ৩৬তম প্রভাবশালী নারী হিসেবে মনোনীত হয়েছিলেন। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কোনটা তাঁর দেশের জন্য ভালো, সেটা তিনি বেশ ভালো করে জানেন। ১৯৯৯ সালে বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারানোর পর তিনি বলেছিলেন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর এদিন দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠতম দিন।
হাফিংটন পোস্টের এ বিবরণী নিয়ে দ্বিমত পোষণ করার কিছু নেই। তবে, শুধুমাত্র অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টাইগারদের ঐতিহাসিক টেস্ট বিজয়ের জন্য শেখ হাসিনাকে সুখী মনে করা সুবিবেচনা প্রসূত হবে না। আরো অনেক কারণেই তিনি নিজেকে সুখী অথবা সফল মনে করতে পারেন। তিনি যেমন অনেক বিষ হজম করে নীল কন্ঠ হয়েছেন, তেমনি জাতিকেও দিয়েছেন অনেক কিছু।
আরও দেখুনঃ
Comments are closed.