ঝর্ণার গান কবিতা – কবিতায় কবি ঝরনার গতিময়তা এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিকটি তুলে ধরেছেন কবি “সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত”।
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (জন্ম: ফেব্রুয়ারি ১১, ১৮৮২ – মৃত্যু: জুন ২৫, ১৯২২) বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জনপ্রিয় কবি ও ছড়াকার। রবীন্দ্রযুগের খ্যাতনামা “ছন্দোরাজ” কবি। তার কবিতায় ছন্দের কারুকাজ, শব্দ ও ভাষা যথোপযুক্ত ব্যবহারের কৃতিত্বের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে ছন্দের যাদুকর নামে আখ্যায়িত করেন। মধ্যযুগে ভারতের ইতিহাস, সংস্কৃতি, পৌরাণিক প্রভৃতি বুদ্ধি-বৃত্তিবিষয়ক বিভিন্ন বিষয়ে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্তের অধিকারী।
কাব্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করার আগে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত পিতার ব্যবসায় যোগ দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন ভারতী পত্রিকাগোষ্ঠীর অন্যতম কবি। প্রথম জীবনে তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, অক্ষয় কুমার বড়াল প্রমুখের দ্বারা প্রভাবিত হন। পরে রবীন্দ্র অনুসারী হলেও তিনি স্বতন্ত্র হয়ে ওঠেন।
বাংলা শব্দের সঙ্গে আরবি-ফার্সি শব্দের সমন্বিত ব্যবহার দ্বারা বাংলা কাব্যভাষার শক্তি বৃদ্ধির প্রাথমিক কৃতিত্ব তারই। অনুবাদের মাধ্যমে তিনি বিশ্বের কাব্যসাহিত্যের সঙ্গে বাংলার যোগাযোগ ঘটান। নবকুমার কবিরত্ন, অশীতিপর শর্মা, ত্রিবিক্রম বর্মণ, কলমগীর প্রভৃতি ছদ্মনামে তিনি কবিতা লিখতেন। দেশাত্মবোধ, মানবপ্রীতি, ঐতিহ্যচেতনা, শক্তিসাধনা প্রভৃতি তার কবিতার বিষয়বস্তু।
ঝর্ণার গান কবিতা – সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
চপল পায় কেবল ধাই,
কেবল গাই পরীর গান,
পুলক মোর সকল গায়,
বিভোল মোর সকল প্রাণ।
শিথিল সব শিলার পর
চরণ থুই দোদুল মন,
দুপুর-ভোর ঝিঁঝির ডাক,
ঝিমায় পথ, ঘুমায় বন।
বিজন দেশ, কূজন নাই
নিজের পায় বাজাই তাল,
একলা গাই, একলা ধাই,
দিবস রাত, সাঁঝ সকাল।
ঝুঁকিয়ে ঘাড় ঝুম-পাহাড়
ভয় দ্যাখায়, চোখ পাকায়;
শঙ্কা নাই, সমান যাই,
টগর-ফুল-নূপুর পায়,
কোন গিরির হিম ললাট
ঘামল মোর উদ্ভবে,
কোন পরীর টুট্ল হার
কোন নাচের উৎসবে।
খেয়াল নাই-নাই রে ভাই
পাই নি তার সংবাদই,
ধাই লীলায়,-খিলখিলাই-
বুলবুলির বোল সাধি।
বন-ঝাউয়ের ঝোপগুলায়
কালসারের দল চরে,
শিং শিলায়-শিলার গায়,
ডালচিনির রং ধরে।
ঝাঁপিয়ে যাই, লাফিয়ে ধাই,
দুলিয়ে যাই অচল-ঠাঁট,
নাড়িয়ে যাই, বাড়িয়ে যাই-
টিলার গায় ডালিম-ফাট।
শালিক শুক বুলায় মুখ
থল-ঝাঁঝির মখ্মলে,
জরির জাল আংরাখায়
অঙ্গ মোর ঝলমলে।
নিম্নে ধাই, শুনতে পাই
‘ফটিক জল।’ হাঁকছে কে,
কণ্ঠাতেই তৃষ্ণা যার
নিক না সেই পাঁক ছেঁকে।
গরজ যার জল স্যাঁচার
পাতকুয়ায় যাক না সেই,
সুন্দরের তৃষ্ণা যার
আমরা ধাই তার আশেই।
তার খোঁজেই বিরাম নেই
বিলাই তান-তরল শ্লোক,
চকোর চায় চন্দ্রমায়,
আমরা চাই মুগ্ধ-চোখ।
চপল পায় কেবল ধাই
উপল-ঘায় দিই ঝিলিক,
দুল দোলাই মন ভোলাই,
ঝিলমিলাই দিগ্বিদিক।
ঝর্ণার গান কবিতার মূলভাব ঃ
‘ঝর্ণার গান’ কবিতায় কবি ঝরনার গতিময়তা এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিকটি তুলে ধরেছেন। কবিতায় ঝরনার ছন্দময় শব্দে চঞ্চল ছুটে চলা মানবজীবনের গতিময়তা সৃষ্টির ইঙ্গিত বহন করে। ঝরনার রূপসৌন্দর্যে মানুষ পুলকিত হয়, মানসিক প্রশান্তি লাভ করে। ঝরনা ফুটে চলার পথে আপন ছন্দে বয়ে চলে সমস্ত নীরবতা ভেঙে।
পাখির ডাকহীন নির্জন দুপুর, ভয়ংকর পাহাড়- সবকিছু উপেক্ষা করে ঝরনা পাথরের বুকে আনন্দের পদচিহ্ন রেখে বয়ে চলে। চমত্তার তার ধ্বনিমাধুর্য, বর্ণবৈচিত্র্য। ঝরনার সেই রূপসৌন্দর্য অতুলনীয়। গিরি থেকে পতিত এ জলরাশি পাথরের বুকে আঘাত করে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। মনােহর এ সৌন্দর্য সবাইকে মুগ্ধ করে। কবি ঝরনার জলধারার সৌন্দর্য অবলােকনে আমাদের মানসিক শান্তি ও কর্মস্পৃহা শানিত করার প্রয়াস।
ঝর্ণার গান কবিতা আবৃত্তি ঃ
আরও দেখুনঃ
Comments are closed.