আমি কোন আগন্তুক নই কবিতা – বিখ্যাত এই কবিতাটি লিখেছেন জনপ্রিয় কবি “আহসান হাবীব” ।
আহসান হাবীব (২ জানুয়ারি ১৯১৭ – ১০ জুলাই ১৯৮৫) একজন খ্যাতিমান বাংলাদেশি কবি ও সাহিত্যিক। দীর্ঘ দিন দৈনিক বাংলা পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক পদের দায়িত্ব পালন সূত্রে তিনি স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সাহিত্য অঙ্গনে অভিভাবকের ভূমিকা রেখেছেন। তিনি চল্লিশের দশকের অন্যতম প্রধান আধুনিক কবি হিসেবে পরিগণিত। বাংলা ভাষা সাহিত্যে অবদানের জন্য তাঁকে বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৮ সালে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদক এবং ১৯৯৪ সালে মরণোত্তর দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে।
১২-১৩ বছর বয়সে স্কুলে পড়ার সময়ই ১৯৩৩ সালে স্কুল ম্যাগাজিনে তার একটি প্রবন্ধ ধরম প্রকাশিত হয়৷ ১৯৩৪ সালে তার প্রথম কবিতা মায়ের কবর পাড়ে কিশোর পিরোজপুর গভর্নমেন্ট স্কুল ম্যাগাজিনে ছাপা হয় ৷ পরবর্তী সময়ে ছাত্রাবস্থায় কলকাতার কয়েকটি সাহিত্য পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হলে তার নিজের সম্পর্কে আস্থা বেড়ে যায়। স্কুলে পড়াকালীন তিনি প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার বিষয়বস্তুকে কবিতায় উপস্থাপিত করে পুরস্কৃত হয়েছিলেন। ততদিনে অবশ্য দেশ, মাসিক মোহাম্মদী, সাপ্তাহিক বিচিত্রার মতো নামিদামি পত্রপত্রিকায় তার বেশ কিছু লেখা প্রকাশিত হয়ে গেছে৷
কলকাতায় গিয়ে শুরু হয় আহসানের সংগ্রামমুখর জীবনের পথচলা৷ সেখানে ১৯৩৭ সালে দৈনিক তকবির পত্রিকার সহ-সম্পাদকের কাজে নিযুক্ত হন । বেতন মাত্র ১৭ টাকা৷ পরবর্তীকালে তিনি ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত কলকাতার বুলবুল পত্রিকা ও ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত মাসিক সওগাত পত্রিকায় কাজ করেন ৷ এছাড়া তিনি আকাশবাণীতে কলকাতা কেন্দ্রের স্টাফ আর্টিস্ট পদে ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কাজ করেন৷
আমি কোন আগন্তুক নই কবিতা – আহসান হাবীব
আসমানের তারা সাক্ষী
সাক্ষী এই জমিনের ফুল, এই
নিশিরাইত বাঁশবাগান বিস্তর জোনাকি সাক্ষী
সাক্ষী এই জারুল জামরুল, সাক্ষী
পূবের পুকুর, তার ঝাকড়া ডুমুরের পালেস্থিরদৃষ্টি
মাছরাঙা আমাকে চেনে
আমি কোনো অভ্যাগত নই
খোদার কসম আমি ভিনদেশী পথিক নই
আমি কোনো আগন্তুক নই
আমি কোনো আগন্তুক নই, আমি
ছিলাম এখানে, আমি স্বাপ্নিক নিয়মে
এখানেই থাকি আর
এখানে থাকার নাম সর্বত্রই থাকা–
সারা দেশে।
আমি কোনো আগন্তুক নই। এই
খর রৌদ্র জলজ বাতাস মেঘ ক্লান্ত বিকেলের
পাখিরা আমাকে চেনে
তারা জানে আমি কোনো অনাত্মীয় নই।
কার্তিকের ধানের মঞ্জরী সাক্ষী
সাক্ষী তার চিরোল পাতার
টলমল শিশির, সাক্ষী জ্যোৎস্নার চাদরে ঢাকা
নিশিন্দার ছায়া
অকাল বার্ধক্যে নত কদম আলী
তার ক্লান্ত চোখের আঁধার
আমি চিনি, আমি তার চিরচেনা স্বজন একজন। আমি
জমিলার মা’র
শূন্য খা খা রান্নাঘর শুকনো থালা সব চিনি
সে আমাকে চেনে
হাত রাখো বৈঠায় লাঙ্গলে, দেখো
আমার হাতের স্পর্শ লেগে আছে কেমন গভীর। দেখো
মাটিতে আমার গন্ধ, আমার শরীরে
লেগে আছে এই স্নিগ্ধ মাটির সুবাস।
আমাকে বিশ্বাস করো, আমি কোনো আগন্তুক নই।
দু’পাশে ধানের ক্ষেত
সরু পথ
সামনে ধু ধু নদীর কিনার
আমার অস্তিত্বে গাঁথা। আমি এই উধাও নদীর
মুগ্ধ এক অবোধ বালক।
আমি কোন আগন্তুক নই কবিতার মূলভাব ঃ
‘আমি কোনাে আগন্তুক নই’ কবিতায় কবি জন্মভূমির সঙ্গে তার নিজের বন্ধন ও মানুষের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের দিকটি তুলে ধরেছেন। এখানে গ্রামীণ জনপদের সঙ্গে নিবিড় বাধনে বাধা মানুষের জীবনাচরণ ফুটে উঠেছে। গ্রামীণ প্রকৃতির নানা অনুষঙ্গে কবির প্রাত্যহিক জীবনের সম্পৃক্ততার দিকটি প্রকাশ পেয়েছে। গ্রামের মাঠ-ঘাট-পথ-প্রান্তরের মতাে খেতের সরু পথ, তার পাশে ধানের সমারােহ, একটু দূরে বিশাল নদীর কিনার কবির মনের ভেতর, অস্থিমজ্জায় গ্রথিত হয়ে আছে। কবির কাছে দেশ মানে আপন সত্তায় অনুভব করা।
তিনি নিজেকে কোনাে আগন্তুক নন বলে যে দাবি করেছেন, তার সপক্ষে প্রকৃতির নানা কিছুর সঙ্গে পরিচয়ের কথা বলেছেন। জন্মভূমি, আকাশ, ফুল-পাখি, জোনাকি, পুকুর, মাছরাঙা সবই তার বহুদিনের চেনা, তারাও তাকে ভালাে করে চেনে। কার্তিকের ধানের মঞ্জরির চিরােল পাতার টলমল শিশির, জোছনা রাতে নিশিন্দার ছায়া, তার সাক্ষী।
কবির প্রিয় গ্রামীণ জনপদের মানুষ কদম আলী, জমিলার মা সবাই তাকে স্বজনবলে জানে। তিনি আগন্তুক নন বলেই তারা সবাই তাকে আপন বলেই মানেন। তিনিও এই গ্রামীণ জনপদেই খুঁজে পেয়েছেন আত্মার অস্তিত্ব। ‘আমি কোনাে আগন্তুক নই’ কবিতায় জন্মভূমির মধ্যে শিকড় গেড়ে মানুষ যে সমগ্র দেশকে আপন করে পায়, এই সত্যটিই ধ্বনিত হয়েছে।
আমি কোন আগন্তুক নই কবিতা আবৃত্তি ঃ
আরও দেখুনঃ